নবম শ্রেণি ইতিহাস
অধ্যায় ১ : ফরাসি বিপ্লবের কয়েকটি দিক (Mark-4/8)
১. ফ্রান্সের 'সন্ত্রাসের শাসন' - এর কারণ কী?
❏ ভূমিকা : ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২১ জানুয়ারি ফরাসিরাজ ষোড়শ লুইয়ের প্রাণদণ্ডের ফলে ফ্রান্সের অভ্যন্তরে ও পররাষ্ট্রীয় ব্যাপারে এক ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এই অবস্থায় ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২ জুন জ্যাকোবিনদের শাসন শুরু হয়। ফ্রান্সে এই আপৎকালীন শাসনব্যবস্থাকে সন্ত্রাসের শাসন বলা হয় ৷
❏ সন্ত্রাসের শাসনের কারণ :
① অভ্যন্তরীণ সংকট : ষোড়শ লুই-এর প্রাণদণ্ডের পর ফ্রান্সের অভ্যন্তরে রাজতন্ত্রের সমর্থকরা প্রজাতন্ত্রী সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তারা প্রতিবিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তুলে সরকারি আইনের প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রকাশ করে।
② বৈদেশিক আক্রমণ : ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া প্রভৃতি দেশ ফ্রান্সের বিরুদ্ধে প্রথম শক্তিজোট গড়ে তোলে। এরপর তারা দ্রুত ফ্রান্সের দিকে অগ্রসর হয় এবং বিভিন্ন রণাঙ্গনে ফরাসিবাহিনীকে পরাজিত করতে থাকে।
③ সন্ত্রাসের শাসনের সূচনা : উক্ত সংকটময় পরিস্থিতির নিরসনে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২ জুন জ্যাকোবিন দলের নেতা রোবসপিয়রের নেতৃত্বে ফ্রান্সে চরমপন্থী শাসন প্রবর্তিত হয়। এটিই 'সন্ত্রাসের রাজত্ব' বা ‘সন্ত্রাসের শাসন’ নামে পরিচিত।
④ সংগঠনসমূহ : সন্ত্রাসের শাসন পরিচালনার জন্য কয়েকটি সংগঠনের ওপর পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেগুলি হল— রোবসপিয়রের নেতৃত্বে জননিরাপত্তা সমিতি, সাধারণ নিরাপত্তা সমিতি, সন্দেহের আইন, বিপ্লবী বিচারালয় ও বিপ্লবের বধ্যভূমি।
⑤ লাল সন্ত্রাস : জ্যাকোবিন নেতা হিবার্ট, দাঁতো, প্রমুখ সন্ত্রাসের ভয়াবহতার প্রতিবাদ করলে ক্ষুব্ধ রোবসপিয়র ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলের মধ্যভাগে এদের প্রাণদণ্ড দেন। এরপর টানা তিন মাস রোবসপিয়রের নেতৃত্বে সন্ত্রাস ভয়াবহ আকার ধারণ করে এবং প্রায় ৫০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। এই পর্বে সংঘটিত সন্ত্রাসকে 'লাল সন্ত্রাস' বলা হয়।
⑥ সন্ত্রাসের অবসান : সন্ত্রাসের শাসন নিয়ে ইতোমধ্যে জ্যাকোবিন দলে মতবিরোধ ও আতঙ্ক দেখা যায় এবং ওই সময় বৈদেশিক আক্রমণের সম্ভাবনা দূর হয়। রোবসপিয়র আর কিছুদিন সন্ত্রাসের শাসন কায়েম রাখতে চাইলে জ্যাকোবিন দলের আতঙ্কিত সদস্যরা রোবসপিয়র ও তাঁর অনুগামীদের বন্দি করে। শেষ পর্যন্ত ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জুলাই রোবসপিয়রকে গিলোটিনে হত্যা করা হলে সন্ত্রাসের রাজত্বের অবসান ঘটে ।
❏ উপসংহার : জ্যাকোবিন দলের নেতৃত্বে ফ্রান্সে সন্ত্রাসের শাসন ভয়াবহ হয়ে ওঠে। প্রায় ৫০ হাজার মানুষ এর ফলে সন্ত্রাসের বলি হয় ও বহু মানুষ চিরদিনের জন্য নিখোঁজ হয়ে যায়। তাই বলা হয় যে— সন্ত্রাসের দ্বারা বিপ্লব তার নিজ সন্তানদের গিলে ফেলে।
২. ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা আলোচনা করো।
❐ ভূমিকা : ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত ফরাসি বিপ্লবের পশ্চাতে দার্শনিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে টেইন, সেতোব্রিয়াঁ, জোরেস, মাতিয়ে প্রমুখ ঐতিহাসিক মনে করেন। ঐতিহাসিকগণ বলেন যে, দার্শনিকগণ তাঁদের লেখনীর সাহায্যে ফরাসি রাষ্ট্র ব্যবস্থার ত্রুটিগুলি তুলে ধরে শোষিত ও অবহেলিত মানুষের মনে বিপ্লবের বীজ রোপণ করেন।
❐ দার্শনিকদের অবদান বা ভূমিকা : ফ্রান্সের জনগণের মনে বিপ্লবের বীজ যাঁরা রোপণ করেছিলেন তাঁরা হলেন-
(ক) মন্তেস্কু : দেশের বঞ্চিত শ্রেণির প্রাণপুরুষ মন্তেস্কু তাঁর 'স্পিরিট অব লজ’ বা ‘আইনের মর্ম' গ্রন্থে সম্রাটের স্বৈরাচারী শাসন ও স্বর্গীয় অধিকার তত্ত্বের তীব্র সমালোচনা করেন। আবার নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের সমর্থক মন্তেস্কু ‘দ্য পার্সিয়ান লেটার্স' গ্রন্থে ফ্রান্সের পুরাতনতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের কঠোর সমালোচনা করেন। এর পাশাপাশি তিনি ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির মাধ্যমে মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার উদ্দেশ্যে দেশের আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগকে পৃথক করার দাবি জানান৷
(খ) ভলতেয়ার : ফ্রান্সের অন্যতম দার্শনিক, সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদ ভলতেয়ার তাঁর ‘কাঁদিদ’ও ‘ফিলোজোফিক্যাল ডিকসনারি' গ্রন্থের মাধ্যমে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের তীব্র নিন্দা করেন। এ ছাড়া তিনি ফরাসি গির্জার দুর্নীতি, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও অত্যাচারকে আক্রমণ করে ক্যাথোলিক গির্জাকে ‘বিশেষ অধিকারপ্রাপ্ত উৎপাত বলে অভিহিত করেন।
(গ) রুশো : অষ্টাদশ শতাব্দীর সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় দার্শনিক জ্যঁ জ্যাক রুশো তাঁর 'Social Contract' বা 'সামাজিক চুক্তি' গ্রন্থে রাজার ঐশ্বরিক ক্ষমতা যুক্তি সহকারে খণ্ডন করেন এক্ষেত্রে তিনি বলেন, এক চুক্তির দ্বারা রাজা শাসন ক্ষমতা লাভ করেছিলেন, তাই রাজাকে যে-কোনো সময় ক্ষমতাচ্যুত করার অধিকার জনগণের রয়েছে। আবার ‘Origin of Inequality' বা 'অসাম্যের সূত্রপাত' গ্রন্থে তিনি বলেন, মানুষ স্বাধীন হয়ে এবং সমান অধিকার নিয়ে জন্মায় কিন্তু বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থা তাকে দরিদ্র ও পরাধীন করে।
(ঘ) ডেনিস দিদেরো ও ডি. এলেমবার্ট : সতেরো খণ্ডে প্রকাশিত বিশ্বকোশের রচয়িতা ডেনিস দিদেরো ও ডি. এলেমবার্ট রাষ্ট্র ও গির্জার অন্যায়ের কঠোর সমালোচনা করেন। তাঁদের রচনায় রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ঐতিহাসিক প্রভৃতি বিষয় স্থান পায়।
(ঙ) ফিজিওক্র্যাট গোষ্ঠী : অষ্টাদশ শতাব্দীর ফ্রান্সে ফিজিওক্র্যাট নামে অর্থনীতিবিদ গোষ্ঠী বাণিজ্যে শুল্কনীতি নিয়ন্ত্রণ প্রথার তীব্র সমালোচনা করে অবাধ বাণিজ্য নীতি ও বেসরকারি শিল্প স্থাপনের দাবি জানায়।
❐ ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের প্রভাব : ① এডমন্ড বার্কের মতে, ফরাসি বিপ্লব ছিল “দার্শনিকদের ষড়যন্ত্রের ফলশ্রুতি”। ② দর্শনের ব্যবহারিক প্রয়োগের দ্বারা ফরাসি দার্শনিকগণ বাস্তব অবস্থার অন্যায় ও যুক্তিহীন দিকগুলির প্রতি ফরাসিবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ③ ফরাসি দার্শনিকগণ পারলৌকিক ও আধ্যাত্মিক বিষয় থেকে মানুষকে দৈনন্দিন ব্যবহারিক জীবনে নিয়োজিত করেছিলেন। ④ সরাসরি বিপ্লবের কথা না বললেও ফ্রান্সের দার্শনিকরা ফরাসিবাসীর মনের মধ্যে বিপ্লবী মানসিকতা গড়ে তুলেছিলেন। ⑤ প্রাক্-বিপ্লব যুগের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য চিহ্নিতকরণ করেছিলেন সেদেশের দার্শনিকরাই।
❐ উপসংহার : এইভাবে ফরাসি দার্শনিকদের লেখনী ফ্রান্সের জনগণকে প্রেরণা দিয়েছিল। দেখিয়েছিল বাঁচার পথ। শিখিয়েছিল অধিকার অর্জনের মন্ত্র। যার পরিণতি ছিল বিপ্লব। এছাড়াও ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা নিয়ে দ্বিমত থাকলেও, অধিকাংশ ঐতিহাসিকগকের মতে, দার্শনিকগণ জনগণের মধ্যে বিপ্লবের যে বীজবপন করেছিলেন তা উপযুক্ত জমিতে যথাসময়ে অঙ্কুরিত হয়। তাই বলা যায় যে, ‘বিপ্লব ছিল দর্শনের কন্যা'।
৩. ফ্রান্সে বিপ্লব পূর্ব কর ব্যবস্থার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও?
❐ ফরাসি রাজা চতুর্দশ লুই ইচ্ছেমতো প্রজাদের ওপর কর চাপানোর নিয়ম চালু করেন। রাজাদের হয়ে কর স্থাপন ও তা আদায়ের কাজ করত ফারমিয়ের জেনারেল। ফরাসি সমাজের প্রথম দুই শ্রেণি অর্থাৎ যাজক (First Estate) ও অভিজাতরা (Second Estate) ছিল সুবিধাভোগী।পেইসির চুক্তি (১৫৬১খ্রি.) অনুযায়ী যাজকরা তাদের ভূসম্পত্তির জন্য প্রথা মতো সরকারকে নিয়মিত কর দিত না। তারা কেবল ‘ইচ্ছামতো দান' ও ‘দেসিম' নামক কর দিত। অভিজাতরা কর দিত, যদিও তাদের অনেক ছাড় ছিল । অপরদিকে ফরাসি সমাজের গরিষ্ঠ অংশ তৃতীয় শ্রেণি ছিল সুবিধাহীন। অথচ তাদের কাছ থেকেই সমস্ত কর আদায় করা হত। ফ্রান্সের ত্রুটিপূর্ণ কর ব্যবস্থা সম্পর্কে একটি প্রবাদ প্রচলিত ছিল। প্রবাদটি হল(The Nobles Fight, the Clergy Prays and the People Pay’ অর্থাৎ ‘অভিজাত শ্রেণি যুদ্ধ করে, যাজকশ্রেণি প্রার্থনা করে এবং সাধারণ শ্রেণির মানুষ কর দান করে'।
❐ কর ব্যবস্থার সংক্ষিপ্ত পরিচয় : বিপ্লব পূর্ববর্তী ফ্রান্সের করব্যবস্থা ছিল ভ্রান্ত ও বৈষম্যমূলক। ফ্রান্সের তৃতীয় শ্রেণির মানুষ সরকারকে তিন ধরনের প্রত্যক্ষ কর দিত, যথা— ① ‘টেইলি' অর্থাৎ, একপ্রকার ভূমি কর ② ‘ক্যাপিটেশন' অর্থাৎ, একপ্রকার উৎপাদন কর ③ ‘ভিংটিয়েমে' অর্থাৎ, একপ্রকার আয়কর। সমাজের উচ্চতর শ্রেণি যাজক ও অভিজাতদের কোনোপ্রকার করই দিতে হত না। রাষ্ট্রের করের অধিকাংশ আসত তৃতীয় সম্প্রদায়ের নিকট থেকে মূলত, কৃষক ও বুর্জোয়া শ্রেণিদের নিকট থেকে। ফরাসি কৃষকদের বহন করতে হত এক বিরাট করের বোঝা।
৪. ফরাসি বিপ্লবে নারীদের অবদান সম্পর্কে লেখো।
অথবা, ফরাসি বিপ্লবে নারীদের অংশগ্রহণের ভূমিকা বা অবদান লেখো।
❐ ভূমিকা : ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লবের মতো রাজনৈতিক ও সামাজিক বিপ্লবের বিভিন্ন পর্যায়ে নারীরা সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। বিশেষ করে পাওলিন লিয়ন, ক্লেয়ার লাকোম্বে, অলিম্প দ্য গুজ, মাদাম রোলাঁ প্রমুখের নেতৃত্বে এই বিপ্লব চরমপন্থী আকার নিয়েছিল ও সাফল্য এসেছিল।
❐ ফরাসি বিপ্লবে নারীদের ভূমিকা :
① বাস্তিলের পতন : ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই ফ্রান্সে বাস্তিল দুর্গ ভেঙে ফেলার সময় যেমন বহু নারী শামিল হয়েছিলেন তেমনি পরোক্ষভাবে তাতে যুক্ত হয়েছিলেন আরও অনেক নারী। ② ভার্সাই অভিযান : ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৫-৬ অক্টোবর খাদ্যের দাবিতে প্রায় কয়েকহাজার নারী বিশাল মিছিল সহকারে ভার্সাই রাজপ্রাসাদ অভিযান করেন এবং রাজাসহ পরিবারকে প্যারিসে আসতে বাধ্য করেন। ③ টুইলারিজ অভিযান : ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দের ১০ আগস্ট নারীরা টুইলারিজ রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করেন ৷ ④ রাজতন্ত্র উচ্ছেদের দাবি : ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর ফ্রান্সে জাতীয় সম্মেলনের অধিবেশনে রাজতন্ত্র উচ্ছেদের দাবিতে নারীরা সোচ্চার হয়েছিলেন। ⑤ সমানাধিকারের দাবি : অলিম্প দ্য গুজ-এর নেতৃত্বে ফ্রান্সের নারীরা সংবিধান সভার কাছে পুরুষের সমান অধিকারের দাবি জানান ।
⑥ সভাসমিতি গঠন : ক্লেয়ার লাকোম্বে ও পাওলিন লিয়ন-এর নেতৃত্বে নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য ফ্রান্সে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে বিপ্লবী প্রান্ত নারী সমিতি গঠিত হয়।
❐ উপসংহার : ফরাসি বিপ্লবে নারীদের অংশগ্রহণ ও তাদের আন্দোলন ব্যর্থ হয়নি। তারা দাবি আদায়ের যে ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল তা ভবিষ্যতের দিশা দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিশেষ করে নারীদের হাতে বন্দি হয়ে সমগ্র রাজপরিবার ভার্সাই থেকে প্যারিসে আসতে বাধ্য হয়। এই ঘটনাকে ঐতিহাসিক রাইকার বলেছেন, “রাজতন্ত্রের শবযাত্রা।”
৫. ফ্রান্সের 'দৈবরাজ তন্ত্র'-এর সম্পর্কে আলোচনা করো।
❐ ভূমিকা : রাজতন্ত্রের ইতিহাসে দেখা যায় বিভিন্ন দেশের রাজতান্ত্রিক শাসকগণ নিজেদের ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে পরিচায় দিয়ে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন পরিচালনা করতেন। এইরূপ রাজতন্ত্র দৈব রাজতন্ত্র বা ঈশ্বরিক অধিকারতন্ত্র নামে পরিচিত। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্সের স্বৈরাচারী রাজাদের শাসনের অন্যতম ভিত্তি ছিল দৈব রাজতন্ত্র।
❐ দৈব রাজতন্ত্রের উল্লেখযোগ্য দিক :
① রাজা ঈশ্বরের প্রতিনিধি : ফ্রান্সের রাজা হলেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি এবং তিনি দৈব নির্দেশ অনুযায়ী রাজ্য শাসনের অধিকার পেয়েছেন, তাই তাঁর কাজ বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো প্রশ্ন করা যেত না। বুরবোঁ শাসকগণ স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রকে কায়েম রাখার জন্য নিজেদের ‘ঈশ্বরের প্রতিনিধি' বলে ঘোষণা করতেন। ② রাজার শ্রেষ্ঠত্ব : প্রাক্ বিপ্লব ফ্রান্সে প্রচার করা হত ফরাসি জনগণের নিকট রাজা অভ্রান্ত বা শ্রেষ্ঠ। তিনি কোনো ভুল করতে পারেন না।
③ জবাবদিহির ঊর্ধ্বে : ঈশ্বরের ইচ্ছায় বুরবোঁ সন্তানেরা রাজা হয়েছেন। তাই তাঁদের কৃতকার্যের জন্য একমাত্র ঈশ্বরের নিকট ছাড়া আর কোথাও জবাবদিহি করতে তাঁরা বাধ্য নন। ④ রাজার ক্ষমতা অনিয়ন্ত্রিত : দৈব রাজতন্ত্রের ধারণা অনুযায়ী রাজার ক্ষমতা হল অনিয়ন্ত্রিত ও সীমাহীন। তিনি রাজ্যের আইন, বিচার ও শাসনব্যবস্থার প্রধান।
⑤ প্রজারা গুরুত্বহীন : দৈব রাজতন্ত্রের সুযোগে বুরবোঁ শাসকগণ ফরাসি জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। ফ্রান্সের প্রশাসনে প্রজাদের কোনো ভূমিকা ছিল না ৷
❐ উপসংহার : ফ্রান্সের বুরবো রাজাদের দৈব রাজতন্ত্রের ধারণা দার্শনিক রুশোর রচনায় সমালোচিত হয়েছিল। ফরাসি বিপ্লবের ফলে রাজতন্ত্র উঠে গেলে দৈব রাজতন্ত্রের ধারণায় আঘাত লাগে। বুরবোঁ রাজা চতুর্দশ লুইয়ের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, “যিনি জনগণকে রাজা উপহার দিয়েছেন, তিনি চেয়েছেন জনগণ তাঁকে তাঁর লেফটেন্যান্টদের মতোই যেন সম্মান করে।”
৬. ফ্রান্সকে 'ভ্রান্ত অর্থনীতির জাদুঘর' বলা হয় কেন?
অথবা, ফরাসি বিপ্লবের অর্থনৈতিক কারণ আলোচনা করো।
❐ ভূমিকা : ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লব আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই বিপ্লবের মূল কারণ হিসেবে সেদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা দায়ী ছিল। তাই অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথের মতে, “বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্স ছিল ভ্রান্ত অর্থনীতির জাদুঘর।” আবার ঐতিহাসিক কোবান ফরাসি বিপ্লবকে অসংখ্য ছোটো-বড়ো খরস্রোতা নদীর সমন্বয়ে ছড়িয়ে পড়া ভয়ানক বন্যার সঙ্গে তুলনা করেছেন।
❐ ভ্রান্ত অর্থনীতির জাদুঘর : ① সরকারি অপব্যয় : ফরাসি রাজাদের অমিতব্যয়িতা, বিলাসিতা ফ্রান্সের রাজকোশকে শূন্য করে দিয়েছিল। বিশেষ করে রানি মেরি আঁতোয়ানেতের বিলাসপূর্ণ জীবনযাপন সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলে। ② ত্রুটিপূর্ণ কর ব্যবস্থা : প্রাক্ বিপ্লব ফ্রান্সে রাষ্ট্র, গির্জা ও জমিদাররা তৃতীয় শ্রেণির কাছ থেকে টেইলি, ক্যাপিটেশন, ভিটিংয়েমে প্রভৃতি প্রত্যক্ষ কর ছাড়াও গ্যাবেল, টাইথ, এইদস করভি প্রভৃতি পরোক্ষ কর আদায় করত। এইসব কর প্রদানের ফলে তাদের হাতে উৎপন্ন ফসলের মাত্র ২০ শতাংশ অবশিষ্ট থাকত। অপরদিকে যাজক ও অভিজাত শ্রেণিকে এই কর প্রদান করতে হত না। এই ত্রুটিপূর্ণ কর ব্যবস্থা ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম কারণ। ③ সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতি : রাজস্ব আদায়কারী সরকারি কর্মচারীরা প্রজাদের কাছ থেকে অসাধু উপায়ে উচ্চ হারে অত্যন্ত নিষ্ঠুরতার সাহায্যে কর আদায় করত। ত্রুটিপূর্ণ অর্থনীতির জন্য ফ্রান্সে দ্রব্যমূল্য ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেলে খাদ্য ও অন্যান্য দ্রব্য গরিব মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। অপরদিকে ধনী বুর্জোয়া, ব্যবসায়ী, শিল্পপতিরা স্বাধীন ও অবাধ বাণিজ্যের জন্য শুল্ক ও নিয়ন্ত্রণ লোপের দাবি জানায় । ④ যুদ্ধে অর্থ ব্যয় : চতুর্দশ লুই, পঞ্চদশ লুই ও ষোড়শ লুই অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধে, সপ্তবর্ষের যুদ্ধে ও আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়ে বিপুল অর্থ ব্যয় করেন। ফলে ফ্রান্সে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। অর্থনৈতিক সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ফ্রান্সের রাজা ষোড়শ লুই কর ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস ও অর্থনৈতিক সংস্কারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ফলে ১৭৫ বছর পর ফরাসি পার্লামেন্ট স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন ডাকলে ফরাসি বিপ্লবের সূচনা হয়। মোর্স স্টিফেন্সের মতে, “ফরাসি বিপ্লবের মূল কারণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক, দার্শনিক ও সামাজিক নয়।”
❐ উপসংহার : কিন্তু দুঃখের বিষয় লুই রাজারা এই আর্থিক সংকট মোচনের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। বরং সাধারণ মানুষের ওপর ক্রমাগত করের বোঝা বেড়ে যায়। ফলে বিপ্লবের পূর্বে ফরাসি রাজকোশ দেউলিয়া হয়ে পড়ে। এজন্য অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ ফ্রান্সকে একটি ‘ভ্রান্ত অর্থনীতির জাদুঘর' বলে উল্লেখ করেছিলেন।
৭. টীকা লেখো : অভিজাত বিদ্রোহ।
❐ ভূমিকা : ফরাসি রাজা ষোড়শ লুই ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে দেশের সমস্ত প্রাদেশিক পার্লামেন্ট মুলতুবি করে সকল সম্প্রদায়ের কাছ থেকে কর আদায়ের উদ্যোগ নিলে ক্ষুব্ধ সুবিধাভোগী অভিজাত শ্রেণি রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। ফরাসি বিপ্লবের প্রথম পর্যায়ের এই বিদ্রোহ অভিজাত বিদ্রোহ নামে পরিচিত। অধ্যাপক গুডউইন-এর মতে, “১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লবের প্রত্যক্ষ কারণ কৃষক শ্রেণির অর্থনৈতিক অসন্তোষ বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির রাজনৈতিক অসন্তোষের মধ্যে না খুঁজে, ফরাসি অভিজাতদের প্রতিক্রিয়াশীল উচ্চাকাঙ্ক্ষার মধ্যে খুজতে হবে।”
❐ অভিজাত বিদ্রোহের কারণ :
① ক্যালোনের প্রস্তাব : আর্থিক অসংগতি দূরীকরণের উদ্দেশ্যে অর্থমন্ত্রী ক্যালোন তামাক ও লবণের ওপর একচেটিয়া সরকারি নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেন। এ ছাড়া তিনি সমহারে ভূমিকর ধার্য করলে অভিজাত শ্রেণির বিরোধিতায় এই সংস্কার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ② ব্রিয়ার প্রস্তাব : পার্লামেন্ট অফ প্যারিসে নতুন অর্থমন্ত্রী ব্রিয়াঁ অর্থনৈতিক প্রস্তাব পেশ করলে পার্লামেন্ট ওই প্রস্তাব নাকচ করে জানায় যে কর বসানোর অধিকার আছে কেবলমাত্র স্টেটস জেনারেলের। ③ পার্লামেন্টের সদস্যকে কিছু নির্বাসন : ষোড়শ লুই প্যারিস পার্লামেন্টের কয়েকজন সদস্যের উত্ত্যক্ত আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে নিজ ভ্রাতা ডিউক অফ অর্লিয়েন্সসহ তিনজনকে নির্বাসিত করে। এতে পার্লামেন্ট ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং আইন পাস করে বিনা বিচারে গ্রেফতার, বিচারক অপসারণ প্রভৃতি বিষয়ে রাজার ক্ষমতা কেড়ে নেয়।
④ পার্লামেন্ট মুলতুবি : পার্লামেন্টের আইনে ক্ষুব্ধ হয়ে রাজা ফ্রান্সের সমস্ত প্রদেশের পার্লামেন্টগুলি মুলতুবি করে ৫৭টি নতুন বিচারালয় স্থাপন করেন ও নিজের প্রস্তাবিত সংস্কারগুলিকে আইনে পরিণত করেন। ⑤ বিদ্রোহের সূচনা : ফরাসি রাজার হঠকারী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে তুলোঁ, দ্যাফিনে, দুজোঁ প্রভৃতি স্থানে অভিজাতরা ব্যাপক বিদ্রোহ শুরু করে। অবশেষে রাজা ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের মে মাসের মধ্যেই স্টেটস জেনারেল আহ্বানের প্রতিশ্রুতি দেন।
❐ উপসংহার : অভিজাত বিদ্রোহের ফলেই রাজতন্ত্রের মর্যাদা আঘাতপ্রাপ্ত হয়। পাশাপাশি রাজার ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতা ও স্বৈরতন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপর স্টেটল জেনারেল আহ্বানের মধ্য দিয়েই ফরাসি বিপ্লবের সূচনা হয়।
৮. 'রাজনৈতিক কারাগাররূপে ফ্রান্স' – ব্যাখ্যা করো।
অথবা, বিপ্লব পূর্ববর্তী ফ্রান্সকে রাজনৈতিক কারাগার' বলা হয় কেন?
❐ ভূমিকা : অষ্টাদশ শতাব্দীর ফ্রান্সে বুরবোঁ রাজবংশের স্বৈরাচারী শাসন বিদ্যমান ছিল এবং রাজারা স্বর্গীয় অধিকার নীতি অনুসারে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। তাই ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের মতে, “বিপ্লব পূর্ববর্তী ফ্রান্স ছিল রাজনৈতিক কারাগার।” ফ্রান্সের রাজনৈতিক অবস্থা ও বুরবোঁ রাজবংশের দায়িত্ব আলোচনা করলে যে বিষয়গুলি গুরুত্ব পায় সেগুলি হল—
❐ বিপ্লবপূর্ব ফ্রান্সের রাজনৈতিক অবস্থা :
① স্বৈরাচারী শাসন : ফরাসি বিপ্লবের আগে ফ্রান্সে ছিল বুরবোঁ রাজবংশের স্বৈরাচারী শাসন। রাজা চতুর্দশ লুই ঘোষণা করেন, “আমিই রাষ্ট্র”। পরবর্তীকালে পঞ্চদশ লুই ও ষোড়শ লুই স্বৈরতন্ত্রকেই গ্রহণ করার ফলে ফরাসি জনগণের থেকে প্রশাসন সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
② প্রশাসনিক দুর্নীতি : ফ্রান্সের প্রাদেশিক শাসনের কর্মচারীরা ইনটেনডেন্ট ছিল খুব অত্যাচারী এবং তাদের মাধ্যমে ফরাসি রাজাদের স্বৈরাচার চলত। তাই অত্যাচারিত জনগণ তাদেরকে ‘রক্তলোলুপ নেকড়ে' নামে অভিহিত করেছিল।
③ ত্রুটিপূর্ণ আইনবিধি : ফ্রান্সের আইনবিধি ছিল জটিল, ত্রুটিপূর্ণ এবং সারা দেশে একই রকম আইনবিধির প্রচলন ছিল না। অভিজাত শ্রেণি যেমন তাদের নিজস্ব আইন ভোগ করত – তেমনি রাজা ষোড়শ লুই নিজের ইচ্ছাকেই আইন বলে ঘোষণা করেছিল।
④ গ্রেফতারি পরোয়ানা : ফ্রান্সের রাজকর্মচারীরা লেতর-দ্য-ক্যাশে নামে গ্রেফতারি পরোয়ানার সাহায্যে যে-কোনো ব্যক্তিকে বিনা বিচারে গ্রেফতার ও আটক করে রাখত।
⑤ স্বাধীনতার অভাব : ফ্রান্সের তৃতীয় সম্প্রদায়ের জনগণের রাজনৈতিক অধিকার ও বাক্স্বাধীনতা ছিল না। ফরাসি প্রশাসন ব্যবস্থা রাজার ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণের বাইরে প্রধানত অভিজাতদের হাতে চলে যায়। ঐতিহাসিক শেভিলের মতে, “রাজার নাম করে অভিজাতরাই প্রশাসন চালাতেন।”
❐ উপসংহার : বুরবোঁ রাজাদের শাসনে জনগণের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত অধিকার চলে যায়। ফলে স্বৈরাচারী ও অত্যাচারী শাসনের বিরুদ্ধে প্রথমে অভিজাতরা ও পরে সাধারণ মানুষ বিপ্লবের সূচনা করেছিল, যা ফরাসি বিপ্লব নামে পরিচিত।
৯. টীকা লেখো : টেনিস কোর্টের শপথ।
অথবা, টেনিস কোর্টের শপথের গুরুত্ব আলোচনা করো।
❐ ভূমিকা : ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসে পুরাতনতন্ত্রের বিরুদ্ধে তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রথম ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ ছিল টেনিস কোর্টের শপথ (১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুন)। বলা বাহুল্য এই ঘটনাটি এক দুঃসাহসিক ও বিপ্লবাত্মক পদক্ষেপ। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৫ মে স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন শুরু হলে ফ্রান্সের তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা এক কক্ষে বসা ও মাথাপিছু ভোটের দাবিতে সরব হয়। এই সময় মিরাব্যু, লাফায়েৎ, অ্যাবে সিয়েস প্রমুখ উদারপন্থী অভিজাত প্রতিনিধিরা তৃতীয় সম্প্রদায়ে যোগ দিলে এই সম্প্রদায় শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ফ্রান্সের রাজা তৃতীয় সম্প্রদায়ের দাবি অস্বীকার করলে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জুন তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা এক সভায় মিলিত হয়ে তাদেরকে সমগ্র জাতির প্রতিনিধি ও তাদের সভাকেই ‘জাতীয় সভা' বলে ঘোষণা করেন। এর পাশাপাশি তারা জানিয়ে দেয় যে কর ধার্যের অধিকার একমাত্র তাদেরই আসে।
❐ টেনিস কোর্টের শপথ : ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুন তৃতীয় শ্রেণির প্রতিনিধিরা জাতীয় সভাগৃহে প্রবেশ করতে গিয়ে দেখে সভাগৃহ তালাবন্ধ। ক্ষুব্ধ সদস্যরা তখন মিরাব্যু ও অ্যাবে সিয়েসের নেতৃত্বে নিকটবর্তী টেনিস কোর্টে সমবেত হয়ে শপথ গ্রহণ করে যে, যতদিন না ফ্রান্সের জন্য একটি নতুন সংবিধান তৈরি হচ্ছে ততদিন তারা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাবে। এই ঘটনা টেনিস কোর্টের শপথ নামে পরিচিত।
❐ টেনিস কোর্টের গুরুত্ব : ① রাজার বিরোধিতা : টেনিস কোর্টের শপথের দ্বারা ফ্রান্সে প্রথম প্রত্যক্ষভাবে রাজা ও রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করা হয়। ② সম্প্রদায়গত ঐক্য : জাতীয় সভার তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি ছিল ৬২১ জন। তার সঙ্গে যাজকদের ১৩৯ জন ও অভিজাতদের ৪৭ জন প্রতিনিধি যোগ দিলে যেমন সম্প্রদায়গত ঐক্য গড়ে ওঠে তেমনি গোটা পরিস্থিতি রাজার বিরুদ্ধে চলে যায়। ③ বুর্জোয়া বিপ্লব : অবশেষে ফ্রান্সের রাজা ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জুন তৃতীয় সম্প্রদায়ের উক্ত দাবি এবং একত্রে অধিবেশনে বসা ও মাথাপিছু ভোটের দাবি মেনে নেয়। এই ঘটনা বুর্জোয়া বিপ্লব নামে পরিচিত। ④ বিপ্লবের নিয়ন্ত্রণ : ওই ঘটনার পর থেকে ফরাসি বিপ্লবের নিয়ন্ত্রণ কার্যত তৃতীয় সম্প্রদায়ের বুর্জোয়াদের হাতে চলে যায়।
❐ উপসংহার : টেনিস কোর্টের শপথের মাধ্যমে তৃতীয় সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ সাফল্য এবং রাজার বিরুদ্ধে যে বিপ্লবের সূত্রপাত তা এড়ানো যেত যদি রাজা তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতি সহানুভূতিশীল হতেন। ডেভিড টমসন বলেন যে, “রাজা যদি একটু বিপ্লবী হতেন, তাহলে তিনি এই জটিলতা থেকে উদ্ধার পেতেন।”
১০. টীকা লেখো : বাস্তিল দুর্গের পতন।
অথবা, বাস্তিল দুর্গের পতনের তাৎপর্য বা গুরুত্ব আলোচনা করো।
❐ ভূমিকা : ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই ফরাসি বিপ্লবের গতিপথে চরম স্বৈরতন্ত্রের প্রতীক বাস্তিল দুর্গের পতন একটি যুগের পতন ঘটায়। ঐতিহাসিক গুডউইন বলেছেন, “বাস্তিলের পতনের ঘটনা সমগ্র বিশ্বে স্বাধীনতার উন্মেষকাল হিসেবে চিহ্নিত।”
❐ বাস্তিল দুর্গের পতন :
① পতনের কারণ : প্রবল চাপে পড়ে ফ্রান্সের রাজা ষোড়শ লুই বুর্জোয়াদের দাবি মেনে একত্রে জাতীয় সভার অধিবেশন ও মাথাপিছু ভোটের দাবি মেনে নেন। কিন্তু সেটি মন থেকে মেনে না নিতে পেরে তিনি প্যারিস ও ভার্সাইতে প্রায় ৩০ হাজার রাজসৈন্য মোতায়েন এবং জনপ্রিয় অর্থমন্ত্রী নেকারকে পদচ্যুত করেন। এতে উত্তেজিত জনতা হিংসার পথে পা বাড়িয়ে অস্ত্রের দোকান ও গির্জাতে লুণ্ঠন চালায়। অপরদিকে খাদ্যের দাবিতে হাজার হাজার মানুষ গ্রাম থেকে শহরের উত্তেজিত মানুষের সঙ্গে মিলিত হলে পরিস্থিতি ভয়ংকর হয়ে ওঠে।
② বাস্তিলের পতন : সশস্ত্র ফরাসি জনতা সরকারি দফতরগুলি আক্রমণ করে বহু নথিপত্র পুড়িয়ে দেয়, সেই সময় গুজব রটে যে, ফ্রান্সের রাজা তৃতীয় সম্প্রদায়কে শায়েস্তা করার জন্য বাস্তিল দুর্গে গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র মোতায়েন করেছেন। এরপর ৭-৮ হাজার মানুষ ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই বাস্তিল দুর্গের রক্ষীদের হত্যা করে দুর্গ দখল করে, বন্দিদের মুক্ত করে দুর্গ ধ্বংস করে দেয়।
❐ তাৎপর্য বা গুরুত্ব :
① স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রে আঘাত : ফ্রান্সে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের প্রতীক বাস্তিল দুর্গ আক্রমণ ও তার পতন ছিল রাজশক্তির বিরুদ্ধে সফল প্রতিবাদ। ② জনগণের শক্তিবৃদ্ধি : বাস্তিলের পতন যেমন ফ্রান্স তথা ইউরোপের মুক্তিপিপাসু মানুষের কাছে মুক্তির অনুপ্রেরণা । তেমনি বাস্তিলের পতনের ফলে প্রমাণিত হয় সাধারণ মানুষের দ্বারা জয়লাভ করা সম্ভব। এটি সাধারণ মানুষের বহুগুণ শক্তিবৃদ্ধি করে। ③ পৌর বিপ্লব : বাস্তিলের পতনের পর প্যারিস, লিয়ঁ, বোরদোঁ প্রভৃতি স্থানে পৌর শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন আসে। গঠিত হয় প্যারী কমিউন এবং গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক উন্মাদনা সৃষ্টি হয় । ④ অভিজাতদের দেশত্যাগ : আতঙ্কিত অভিজাত শ্রেণি ফ্রান্স ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়, বিপ্লব বিরোধী শক্তি হ্রাস পায়।
❐ উপসংহার : বাস্তিলের পতনের পর প্যারিসের শাসন ক্ষমতা বুর্জোয়ারা দখল করে নেয়। গুডউইন বলেছেন, “বাস্তিলের পতনের মতো বহুমুখী ও সুদূরপ্রসারী ঘটনা বিপ্লবে আর ঘটেনি।” ফরাসিরা এই দিনটিকেই স্বাধীনতা দিবস বা জাতীয় দিবস রূপে পালন করে।
১১. টীকা লেখো : সেপ্টেম্বর হত্যাকাণ্ড।
❐ ভূমিকা : ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দের ১০ আগস্ট দ্বিতীয় ফরাসি বিপ্লবের পর সমগ্র ফ্রান্সে এক সন্দেহ ও হিংসার বাতাবরণ তৈরি হয়। তখন রাজতন্ত্রকে সরিয়ে দিয়ে সেদেশে অস্থায়ী প্রশাসনিক কাউন্সিল গঠিত হয়েছিল। এরপর রাজতন্ত্রের সমর্থক সন্দেহে ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে ২ সেপ্টেম্বর ফ্রান্সে যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল, তা সেপ্টেম্বর হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত। জর্জ রুদেঁ-এর মতে, “সেপ্টেম্বর হত্যাকাণ্ড ছিল একটি রহস্যজনক ঘটনা এবং ব্যাখ্যার অতীত।”
❐ সেপ্টেম্বর হত্যাকাণ্ড : ঐতিহাসিক আলফ্রেড কোবান-এর মতে, বিদেশি সেনা ফ্রান্সে প্রবেশ করে কারারুদ্ধ অভিজাত ও রাজতন্ত্রীদের মুক্তি দেবে এবং জনগণের ওপর অত্যাচার চালাবে। এমন গুজব ও আশঙ্কার ফলেই বিপ্লবকে রক্ষার জন্য সেপ্টেম্বর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। উক্ত গুজবকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা ভীতির প্রেক্ষিতে প্যারিস কমিউন নাগরিকদের অস্ত্র জোগাড়ের ডাক ও আইনসভার অধিবেশনে প্রতিটি মানুষকে আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত থাকার কথা বলে । জেকোবিন নেতা জাঁ পল ম্যারা-র নেতৃত্বে ফ্রান্সের কয়েক হাজার উন্মত্ত ও হিংস্র জনতা ২ থেকে ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্যারিসের কারাগারগুলিতে ঢুকে কয়েক হাজার রাজতন্ত্রী বন্দিকে হত্যা করে। প্রদেশ গুলিতেও তারা অনুরূপ হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল। এ ছাড়া রাজতন্ত্রের সমর্থক সন্দেহে অবাধ্য যাজক, অভিজাত ও ভবঘুরেদের তারা হত্যা করে।
❐ গুরুত্ব : সেপ্টেম্বর হত্যাকাণ্ডের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। যেমন—জেকোবিন বিরোধী আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে, যাজক ও অভিজাত সম্প্রদায় ফরাসি সমাজে একেবারে কোনঠাসা হয়ে পড়ে এবং বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করে ফ্রান্সকে সঠিক পথে নিয়েযাওয়ার জন্য সন্ত্রাসের শাসকের সূত্রপাত ঘটে।
❐ উপসংহার : ফ্রান্সের রাজনীতিতে এইভাবে যে অস্থির হিংসাত্মক পরিবেশ গড়ে উঠেছিল তারই চূড়ান্ত পরিণতি ছিল সন্ত্রাসের রাজত্ব ।
১২. ফ্রান্সের ইতিহাসে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ আগস্ট গুরুত্বপূর্ণ কেন?
অথবা, সামন্ততন্ত্রের বিলোপ সাধনে ফরাসি সংবিধান সভা কী কী উদ্যোগ নিয়েছিল?
❐ ভূমিকা : ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৯ জুলাই ফ্রান্সের জাতীয় সভা সংবিধান সভায় রূপান্তরিত হয়ে মূল সংবিধান রচনার আগে যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিল, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ আগস্ট সামন্ততন্ত্রের বিলুপ্তি ঘোষণা। এজন্য ঐতিহাসিক কোবান বলেছেন যে, “ফ্রান্সে অষ্টাদশ শতাব্দী ছিল আধুনিক যুগের সূতিকাগার।”
❐ সামন্ততন্ত্রের বিলোপ সাধনে ফরাসি সংবিধান সভার উদ্যোগ : সামন্ততন্ত্রের বিলোপ সাধনে ফরাসি সংবিধান সভার গৃহীত উদ্যোগগুলি হল— ① আগস্টের ঘোষণা : গুজবের প্রভাবে ফ্রান্সের গ্রামীণ জনগণের আন্দোলনের ফলে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ আগস্ট অভিজাতরা স্বেচ্ছায় তাদের সামন্ততান্ত্রিক অধিকারগুলি ত্যাগ করে। ② ১১ আগস্টের ঘোষণা : ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১১ আগস্ট এক আদেশনামা দ্বারা ফ্রান্সের জাতীয় সভা ঘোষণা করে যে, ফ্রান্সে সামন্তপ্রথা লুপ্ত করা হল। ③ বিভিন্ন প্রথা ও করের বিলোপ : ফ্রান্সে করভি প্রথা, ম্যানর প্রথা, টাইথ প্রভৃতি সামন্ত কর এবং ভূমিদাস প্রথা, বর্গা প্রথা ইত্যাদির বিলোপ করা হয়। ④ সামন্তদের বিশেষ অধিকারের বিলোপ : সরকারি চাকুরিতে অগ্রাধিকার, আইনের হাত থেকে অব্যাহতি, বৈষম্যমূলক কর প্রভৃতি অভিজাতদের বিশেষ সুবিধার বিলোপ করা হয়।
❐ উপসংহার : মূলত ৪ আগস্ট ও ১১ আগস্ট ঘোষণা কার্যত ফ্রান্সে সামন্তপ্রথার মৃত্যু ঘণ্টা বাজায়। জমিদার ও গির্জার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তা কৃষকদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়।
Read More - IX History Click ☟
অধ্যায় ১ : ফরাসি বিপ্লবের কয়েকটি দিক