একাদশ শ্রেণীর দ্বিতীয় সেমিস্টার সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস বৈয়াসিক-মহাভারত

Esita Afrose
0
 

Class-11 2nd Semester Sanskrit Mahabharat

❐ সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস (বৈয়াসিক-মহাভারত)
মার্ক - ২ পরীক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সাজেশন নোটস 

১. মহাভারত কী? মহাভারতের রচয়িতা কে?
➛ মহাভারত একটি মহাকাব্য জাতীয় গ্রন্থ। এই মহাকাব্যে ভরতবংশের উপাখ্যান বর্ণিত হয়েছে। এটি ভারতবর্ষের শিক্ষা, সংস্কৃতি, সভ্যতা এবং অধ্যাত্মচেতনার সমগ্রতায় পরিপূর্ণ হয়ে রয়েছে। মহাভারতের রচয়িতা হলেন কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস।

২. ব্যাসদেব কে?
➛ মহাভারতের রচয়িতা ছিলেন ব্যাসদেব। তাঁর পিতার নাম পরাশরমুনি এবং মাতার নাম সত্যবতী; যমুনার এক দ্বীপে ব্যাসদেবের জন্ম হয়।

৩. ব্যাসদেবের সম্পূর্ণ নাম কী? তাঁকে ‘বেদব্যাস বলা হয় কেন?
➛ ব্যাসদেবের সম্পূর্ণ নাম কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেব। ব্যাস শব্দের অর্থ বিভক্ত করা ৷ মহর্ষি ব্যাসদেব শতশাখাযুক্ত বেদের বিভাজন করেন, তাই তাঁকে ‘বেদব্যাস’ বলা হয় ৷ 

৪. ব্যাসকুট বলতে কী বোঝো?
➛ মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত রচনা করবেন বলে ঠিক করলেন। কিন্তু একসঙ্গে চিন্তা করা ও লেখা অসম্ভব। তাই সিদ্ধিদাতা গণেশ এলেন লেখার জন্য। কিন্তু শর্ত ছিল, তাঁর কলম একবারও থামলে চলবে না৷ তবে, ব্যাসদেবের শর্ত ছিল যে, গণেশ না বুঝে কিছু লিখতে পারবে না৷ মহাভারত লেখার সময় ব্যাসদেব মাঝেমধ্যে এমন কিছু দুর্বোধ্য শ্লোক বলতেন, যা বুঝতে গণেশের বেশকিছু সময় লেগে যেত। এই সময় ব্যাসদেব আরও নতুন কিছু শ্লোক রচনা করে নিতেন। এই দুর্বোধ্য শ্লোকগুলিকে ‘ব্যাসকূট’ বলা হয়। 

৫. 'মহাভারত' এরূপ নামকরণের পিছনে কারণ কী ছিল?
➛ মহাভারতের বিষয়বস্তু ভরতবংশীয়দের মহাযুদ্ধের কাহিনি হলেও এই কাহিনির সঙ্গে মিলিত হয়েছে অজস্র উপাখ্যান, অসংখ্য উপদেশ ও ধর্মের অনুশাসন। মহাভারতের আদিপর্বে নামকরণ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে— ‘মহত্ত্বাদ্ ভারবত্ত্বাচ্চ মহাভারতমুচ্যতে' অর্থাৎ মহত্ত্ব এবং ভারবত্ত্বে অপৌরুষেয় সমগ্র বৈদিক সাহিত্য অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর বলে এই মহাকাব্যটি ‘মহাভারত' নামে প্রসিদ্ধ।

৬. মহাভারত মহাকাব্যের রচনায় কয়টি স্তর দেখা যায়? স্তরগুলির নাম কী কী?
➛ 'মহাভারত'-এর রচনায় তিনটি স্তর লক্ষ করা যায়। প্রথম স্তর ‘ব্যাসদেব' রচিত জয়কাব্য। দ্বিতীয় স্তর ‘বৈশম্পায়ন রচিত ভারত আস্তিকোপাখ্যান অথবা ভারতসংহিতা। তৃতীয় স্তর সৌতি (লোমহর্ষণপুত্র) রচিত মহাভারত।

৭. 'ষট্সংবাদ' কাকে বলে?
➛ মহাভারতের কাহিনি প্রথমে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস আপন শিষ্য বৈশম্পায়নকে শোনান, দ্বিতীয় বারে বৈশম্পায়ন জনমেজয়ের নাগযজ্ঞে জনমেজয়কে পূর্বশ্রুত কাহিনি শোনান এবং তৃতীয় বারে লোমহর্ষণের পুত্র সৌতি শৌনকাদি ঋষিগণকে সেই কাহিনি শোনান। এইভাবে কাহিনিটি তিনজন ব্যক্তি কর্তৃক তিনবার বলা হয়েছে। তাই একে ‘ষট্সংবাদ’ বলা হয়।

৮. প্রাচীন ঐতিহ্যানুসারে মহাভারতের রচনা কোন যুগে হয়েছিল? সর্বপ্রথম কোন গ্রন্থে মহাভারতের উল্লেখ পাওয়া যায়?
➛ প্রাচীন ঐতিহ্যানুসারে মহাভারতের রচনা দ্বাপর যুগে হয়েছিল। সৰ্বপ্ৰথম ঋগবেদের গৃহ্যসূত্র-এ মহাভারতের উল্লেখ পাওয়া যায়।

৯. মহাভারতের উৎস কী ? মহাভারতের অধ্যায় সংখ্যা কয়টি?
➛ মহাভারতের উৎস হল ঋগবেদের আখ্যানসুক্ত, দানসূক্ত, সংবাদসূক্ত এবং নারাশংসী প্রভৃতি। মূল মহাভারতের অধ্যায় সংখ্যা ১৯২৩টি, তবে বর্তমানে প্রাপ্ত মহাভারতে প্রায় ২,১১১টি অধ্যায় রয়েছে।

১০. মহাভারতের পর্বসংখ্যা কয়টি ও কী কী?
➛ 'মহাভারত' অষ্টাদশ পর্বে বিভক্ত। পর্বগুলি হল— (১) আদিপর্ব, (২) সভাপর্ব, (৩) বনপর্ব, (৪) বিরাটপর্ব, (৫) উদ্যোগপর্ব, (৬) ভীষ্মপর্ব, (৭) দ্রোণপর্ব, (৮) স্ত্রীপর্ব, (৯) কর্ণপর্ব, (১০) শল্যপর্ব, (১১) সৌপ্তিকপর্ব, (১২) শান্তিপর্ব, (১৩) অনুশাসনপর্ব, (১৪) আশ্বমেধিকপর্ব, (১৫) আশ্রমবাসিকপর্ব, (১৬) মৌষলপর্ব, (১৭) মহাপ্রস্থানিকপর্ব ও (১৮) স্বর্গারোহণপর্ব।

১১. মহাভারত কোন ছন্দ ও রীতি অবলম্বনে রচিত?
➛ মহাভারত অনুষ্টুপ ছন্দ ও পাঞ্চালী রীতিতে রচিত।

১২. মহাভারতের অপর নামগুলি লেখো।
➛ মহাভারতের অন্যান্য নামগুলি হল-শতসাহস্ৰীসংহিতা, পঞ্চমবেদ, কাবেদ, জয়, ভারত, ভারতকোষ, ভারতসংহিতা।

১৩. মহাভারতকে পঞ্চম বেদ বলে কেন?
➛ ভারতে প্রচলিত জ্ঞান-বিজ্ঞান, ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষের তত্ত্বনীতি এবং জীবনের ঘাতপ্রতিঘাত, দ্বন্দ্ব মহাভারতে নিহিত রয়েছে। তাই চতুর্বেদের পরেই মহাভারতের স্থান। আর এই সমস্ত বিচিত্র বিষয়ের সমাবেশের কারণেই চতুর্বেদের পরে মহাভারতকে ‘পঞ্চম বেদ' বলা হয়।

১৪. 'শতসাহস্ৰীসংহিতা' কাকে বলা হয় ও কেন?
➛ মহাভারতকে ‘শতসাহস্ৰীসংহিতা' বলা হয়। মহাভারতে শতসহস্র বা ১,০০,০০০ শ্লোক নিবদ্ধ থাকায় এই মহাকাব্যকে ‘শতসাহস্ৰীসংহিতা' বলা হয়।

১৫. একলব্য কে? তার অস্ত্রগুরু কে ছিলেন?
➛ নিষাদরাজ হিরণ্যধনুর পুত্র হলেন একলব্য। একলব্য দ্রোণাচার্যকে অস্ত্রগুরু হিসেবে প্রার্থনা করলেও, একলব্য নীচ জাতি হওয়ায় দ্রোণাচার্য তাকে শিক্ষা দেননি। তাই একলব্য দ্রোণাচার্যের একটি মাটির মূর্তিকে গুরু হিসেবে কল্পনা করে নিজের চেষ্টায় অস্ত্রবিদ্যা শিখেছিলেন।

১৬. পাঞ্চালী কাকে বলা হয় ? তার ওইরূপ নামের কারণ কী?
➛ দ্রৌপদীকে পাঞ্চালী বলা হয়। দ্রৌপদী পাঞ্চাল রাজ্যের রাজকন্যা ছিলেন। সেইজন্যই তাকে পাঞ্চালী বলা হয়।

১৭. গীতার রচয়িতা কে? গীতাকে 'সপ্তশতী' বলা হয় কেন?
➛ শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা মহাভারতের ভীষ্মপর্বের অংশবিশেষ। যেহেতু মহাভারতের রচয়িতা মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস সেহেতু গীতার রচয়িতাও তিনিই ৷ অষ্টাদশ যোগাধ্যায়বিশিষ্ট ‘গীতা’ সাতশত (৭০০) শ্লোকে সন্নিবেশিত। তাই গীতাকে ‘সপ্তশতী' বলা হয়

 আরো পড়ুন : 
একাদশ শ্রেণি সংস্কৃত সেমিস্টার  II 
গদ্য
প্রতিজ্ঞাসাধনম্ (অম্বিকাদত্তব্যাস) Click Here
পদ্য
ঋতুচর্যা (মহর্ষি চরক) Click Here
দৃশ্যকাব্য
দানবীরঃ কর্ণঃ – (মহাকবি ভাস) Click Here
ব্যাকরণ
সন্ধি Click Here
শব্দরূপ Click Here
প্রত্যয় Click Here
ধাতুরূপ Click Here
সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস
বৈদিক সাহিত্য Click Here
বৈয়াসিক-মহাভারত Click Here
সংস্কৃত গীতিকাব্য Click Here

❐ সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস (বৈয়াসিক-মহাভারত)
মার্ক - ৪ পরীক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সাজেশন নোটস

১. ভারতীয় সাহিত্যে মহাভারতের প্রভাব আলোচনা করো।
➛ মহর্ষি বেদব্যাস বিরচিত ‘মহাভারত' ভারতীয় জাতীয় মহাকাব্য। সংস্কৃত সাহিত্য এবং বাংলা সাহিত্য থেকে শুরু করে প্রাদেশিক সাহিত্যেও এর প্রভাব চোখে পড়ে।

❐ ভারতীয় সাহিত্যে প্রভাব :  সংস্কৃত সাহিত্য : (নাটক :) মহাভারতাবলম্বী নাটকগুলি হল—কালিদাসের ‘অভিজ্ঞানশকুন্তল’ এবং ‘বিক্রমোর্বশীয়’; ভাসের ‘মধ্যমব্যায়োগ’, ‘কর্ণভার’, ‘উরুভঙ্গ’, ‘দূতবাক্য’, ‘দূতঘটোৎকচ’, ‘পঞ্চরাত্র’; ভারবির ‘কিরাতার্জনীয়’, ভট্টনারায়ণের ‘বেণীসংহার’; কুমারপালের ‘দ্রৌপদী— স্বয়ংবর’; কুলশেখরের ‘তপতীসংবরণ’ এবং ‘সুভদ্রা—ধনঞ্জয়' প্রভৃতি। ② মহাকাব্য : মহাভারতাবলম্বী সংস্কৃত মহাকাব্যগুলি হল— শ্রীহর্ষের ‘নৈষধচরিত’; অমরচন্দ্র সূরির ‘বালভারত’, ক্ষেমেন্দ্রের ‘মহাভারতমঞ্জুরী’; বাসুদেবের ‘যুধিষ্ঠিরবিজয়’; মাঘের ‘শিশুপালবধ’; নীতিবর্মার ‘কীচকবধ’ প্রভৃতি।

❐ বাংলা সাহিত্য : ①  নাটক: মহাভারতাবলম্বী বাংলা নাটকগুলি হল গিরিশ ঘোষের ‘পাণ্ডবগৌরব’, ‘জনা’, ‘অভিমন্যু বধ’, ‘পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাস'; মধুসূদন দত্তের ‘শর্মিষ্ঠা'; তারানাথ শিকদারের ‘ভদ্রার্জুন এবং ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের ‘ভীষ্ম’, ‘নরনারায়ণ' প্রভৃতি।  কাব্য: মহাভারত অনুসারী বাংলা কাব্যগুলি হল—নবীনচন্দ্রের ‘কুরুক্ষেত্র’, ‘প্রভাস’, ‘বৈরতক’; মধুসূদন দত্তের ‘বীরাঙ্গনা” এবং হেমচন্দ্রের ‘বৃত্রসংহার’। অন্যদিকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চিত্রাঙ্গদা', ‘নরকবাস’, ‘বিদায় অভিশাপ', ‘গান্ধারীর আবেদন’ এবং ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’ কাব্যনাট্যগুলি মহাভারত অবলম্বনে লেখা।

❐ অনুবাদ সাহিত্য : মহাভারত অনুসরণে লেখা অনুবাদ সাহিত্যের মধ্যে কাশীরাম দাসের ‘মহাভারত’, কবীন্দ্র পরমেশ্বরের ‘পাণ্ডববিজয়’ এবং শ্রীকর নন্দীর ‘অশ্বমেধকথা' অন্যতম।

❐ প্রাদেশিক সাহিত্য :  ① অসমিয়া :  মাধবদেবের ‘রাজসূয় যজ্ঞ', রামসরস্বতীর ‘মহাভারত'-এর অসমিয়া অনুবাদ, মাধব কন্দলীর 'ভারত- সাবিত্রী' এবং হরিহর বিপর “বব্রু বাহনের যুদ্ধ’। ② গুজরাটি : রামায়ণ অবলম্বী গুজরাটি সাহিত্যের মধ্যে নাকরের ‘চন্দ্ৰহাসাখ্যান’ ‘দ্রৌপদী-স্বয়ম্বর’, ‘সুভদ্রাহরণ’ এবং ভালনের লেখা ‘দুর্বাসাখ্যান’ এবং ‘নলাখ্যান’ অন্যতম ৷ ③ হিন্দি : হিন্দি সাহিত্যে মহাভারতের নিদর্শন মেলে সবলসিংহ চৌহানের মহাভারতের হিন্দি অনুবাদ-এ।  কানাড়ি : প্রথম পল্প রচিত ‘পম্পভারত’। মহাভারতের অমৃত রচনা ভারতীয় কবিমানসকে উদ্দীপিত করেছে। ব্যাসদেব ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন—‘সর্বেষাং কবিমুখ্যানামুপজীব্যো ভবিষ্যতি’। অর্থাৎ তাঁর মহাভারতকথা সর্বকালের কবিদের উপজীব্য হবে। মহর্ষির সেই প্রত্যাশা ফলপ্রসূ হয়েছে।

২. ভারতীয় সমাজ ও সাহিত্যে মহাভারতের প্রভাব লেখো।
➛ মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস রচিত ‘মহাভারত’ মহাকাব্যটি যুগ-যুগান্তর ধরে ভারতের সমাজজীবনে, ধর্মীয় জীবনে ও সাহিত্যে প্রভাব বিস্তার করে আসছে।

❐ ভারতীয় সমাজে প্রভাব :  নৈতিক শিক্ষাদা : ভারতীয় সমাজ মহাভারতের চরিত্রগুলি দ্বারা গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে এসেছে। সত্যনিষ্ঠ, ধর্মপ্রাণ যুধিষ্ঠিরের সততা, তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনের অসাধারণ পৌরুষ গৌরব, অপরাজেয় ভীমের অপ্রতিরোধ্য বাহুবল ভারতবাসীকে অনুপ্রাণিত করে। ক্ষত্রিয়াভিমানিনী দ্রৌপদীর আত্মপ্রত্যয় এবং তেজস্বিতা ভারতীয় রমণীকে উদ্বুদ্ধ করে এসেছে। এ ছাড়াও দানবীর কর্ণের অবিচল প্রত্যয়, গান্ধারীর পতিনিষ্ঠা ইত্যাদি আমাদের মুগ্ধ করে।

 ② প্রবাদবাক্যের প্রচলন : মহাভারতের কয়েক হাজার বছর অতিবাহিত হওয়ার পরেও ভারতীয়রা কোনো ব্যক্তির পরশ্রীকাতরতাকে বোঝাতে শকুনি মামা, দানশীলতাকে বোঝাতে দাতা কর্ণ, সততাকে বোঝাতে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির এবং পরিমাপগত সূক্ষ্মতাকে বোঝানোর জন্য সূচ্যগ্রমেদিনী-র মতো প্রবাদবাক্য ব্যবহার করে।

 পূজা অনুষ্ঠানে ভূমিকা : ভারতীয়দের বাড়িতে কোনো শ্রাদ্ধানুষ্ঠান ‘শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা' পাঠ ব্যতীত সম্পন্নই হয় না। সেই সুধানিশ্রাবী কাহিনি শ্রবণে এবং পঠনে মানুষ কলুষমুক্ত হয়। তাই যথার্থই বলা হয়ে থাকে—যা নেই ভারতে তা নেই ভারতে'।

❐ সাহিত্যে মহাভারতের প্রভাব : সংস্কৃত সাহিত্যের বেশিরভাগ অংশ মহাভারতের রসধারায় পরিপুষ্ট হয়েছে। মহাভারতের বিষয়, আঙ্গিক, আদর্শ, ভাবধারাকে উপজীব্য করে কাব্য ও সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন বহু সাহিত্যিকগণ। কালিদাস, ভবভূতি থেকে শুরু করে আধুনিক ভারতীয় ভাষাতেও মহাভারতাশ্রয়ী একাধিক নজির আছে। মহাভারত অনুসরণে লেখা অনুবাদ সাহিত্যের মধ্যে কাশীরাম দাসের ‘মহাভারত’, কবীন্দ্র পরমেশ্বরের ‘পাণ্ডববিজয়’ এবং শ্রীকর নন্দীর ‘অশ্বমেধকথা' অন্যতম।

৩. মহাভারত সম্পর্কে লেখো।
❐ পরিচিতি : ভারতবর্ষের জাতীয় মহাকাব্যগুলির মধ্যে মহাভারত হল অন্যতম। শুধুমাত্র বিশাল আকৃতির জন্য নয়, বিষয়বস্তুর গৌরবও এই ‘মহাভারত’ নামকরণের অন্যতম কারণ— ‘মহত্ত্বাদ্ ভারবত্ত্বাচ্চ মহাভারতমুচ্যতে”। লেখক : মহাভারতের লেখক হলেন কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস।

❐ শ্লোকসংখ্যা, পর্বসংখ্যা ও অধ্যায় সংখ্যা : মহাভারতে ১৮টি পর্বে এক লক্ষ শ্লোক সম্বলিত; বর্তমানে প্রাপ্ত মহাভারতের তিনটি স্তর যথা—জয় (শ্লোকসংখ্যা-৮,৮০০টি), ভারত (শ্লোকসংখ্যা ২৪,০০০টি) এবং মহাভারত (শ্লোকসংখ্যা ১,০০০০০টি)। মহাভারতের অধ্যায় সংখ্যা ১৯২৩টি।

❐ পর্ব: মহাভারতের পর্বগুলি হল— (১) আদিপর্ব, (২) সভাপর্ব, (৩) বনপর্ব, (৪) বিরাটপর্ব, (৫) উদ্যোগপর্ব, (৬) ভীষ্মপর্ব, (৭) দ্রোণপর্ব, (৮) স্ত্রীপর্ব, (৯) কর্ণপর্ব, (১০) শল্যপর্ব, (১১) সৌপ্তিকপর্ব, (১২) শান্তিপর্ব, (১৩) অনুশাসনপর্ব, (১৪) আশ্বমেধিকপর্ব, (১৫) আশ্রমবাসিকপর্ব, (১৬) মৌষলপর্ব, (১৭) মহাপ্রস্থানিকপর্ব ও (১৮) স্বর্গারোহণপর্ব।

❐ রচনাকাল : মহাভারতের রচনাকাল নিয়ে নানান মতবাদ থাকলেও ভিন্তারনিৎস-এর মতে, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতককে এর রচনাকাল মনে করা হয়।

❐ বৈশিষ্ট্য : ভরতবংশীয় কৌরব ও পঞ্চপাণ্ডবদের বিরোধ মহাভারতের বিষয়বস্তু হলেও ভারতভূমিতে প্রচলিত অজস্র কাহিনি, ইতিহাস, পুরাণ, আখ্যান, গাথা, ধর্মশাস্ত্র প্রভৃতির দ্বারা মহাকাব্যটি মণ্ডিত। তাই এটি পঞ্চম বেদ—যাতে স্ত্রীশূদ্র নির্বিশেষে সকলেরই অধিকার আছে। মহাভারতের পরিশিষ্ট অংশের নাম হল হরিবংশ। আবার শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত বাণীস্বরূপ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা মহাভারতের ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত, যা ছিল হিন্দুধর্মের কাছে অত্যন্ত পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। সুতরাং ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষের আধার মহাভারত সম্পর্কে যথার্থই বলা হয়েছে—
‘ধর্মে চাৰ্থে চ কামে চ মোক্ষে চ ভরতর্ষভ।
যদিহাস্তি তদন্যত্র যন্নেহাস্তি ন তৎ ক্বচিৎ।

৪. মহাভারতের রচনাকাল সম্পর্কে আলোচনা করো।
❐ মহাভারতের রচনাকাল সম্পর্কে প্রচলিত বিভিন্ন মতামত আছে—  
✱ রচনাকাল: ① খ্রিস্টপূর্ব দশম শতকের সাপোক্ত যুক্তি : ম্যাকডোনেলের মতে, মহাভারতের রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব দশম শতকের পরবর্তী হতে পারে না, কারণ যজুর্বেদে কুরু ও পাঞ্চাল এই দুই রাজবংশ মিলিত হতে দেখা যায় এবং অথর্ববেদে কুরু জনপদের রাজা পরীক্ষিতের কথা আছে।

② খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের সাপেক্ষে যুক্তি : আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে পাণিনির ‘অষ্টাধ্যায়ী’-তে যুধিষ্ঠির, ভীম, বিদুর ও মহাভারত প্রভৃতি শব্দের উল্লেখ আছে। আশ্বলায়নের ‘গৃহ্যসূত্র’ (৩/৪/৪) এবং বৌধায়নের ‘ধর্মসূত্র’ (২/২/২৬)-এ মহাভারতের উল্লেখ পাওয়ায় এর রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের দিকে নির্দেশ করে। 

③ খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের সাপেক্ষে যুক্তি : মহাভারতে শিব এবং বিষ্ণুর প্রাধান্য দেখা যায়। মেগাস্থিনিসের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকেই শৈব এবং বৈষ্ণব ধর্মের প্রভূত উন্নতি ঘটেছিল। ④ খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের সাপেক্ষে যুক্তি : পতঞ্জলির ‘মহাভাষ্য’-এ কুরু-পাণ্ডবের উল্লেখ থাকায় মহাভারতের রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক বলে মনে করা হয়।

⑤ খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের সাপেক্ষে যুক্তি : ৪৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৫০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়কালের ভূমিদানপত্রগুলিতে মহাভারতের কথা পাওয়া যায়। ⑥ খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম-অষ্টম শতকের সাপেক্ষে যুক্তি : দার্শনিক কুমারিল ভট্টের উদ্ধৃতি থেকে এবং ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে আবির্ভূত সুবন্ধু ও বাণভট্টের মুখে মহাভারতের কথা জানা যায়। ফলে এর রচনাকাল খ্রিস্টীয় সপ্তম-অষ্টম শতক বলে মনে করা হয়।

উপরোক্ত প্রমাণগুলি থেকে অনুমান করা যায় যে, বর্তমান আয়তনের মহাভারত খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের মধ্যবর্তী কালে মহাভারত রচিত হয়েছিল।

৫. রামায়ণ ও মহাভারতের গৌরাপ্য আলোচনা করো। 
❐ রামায়ণ এবং মহাভারত মহাকাব্যদ্বয়ের মধ্যে প্রাচীনত্বের বিচারে এগিয়ে কে, তা বিচার করা দুরূহ কাজ। এক্ষেত্রে কয়েকটি যুক্তি উপস্থাপন করা যেতে পারে।

❐ রামায়ণ-এর পক্ষে যুক্তি : ① আদিকবি এবং আদিকাব্য : মহাকবি কালিদাসের ‘রঘুবংশম্’ কাব্যে বাল্মীকি ‘আদিকবি’ এবং রামায়ণ ‘কবি প্রথম পদ্ধতি' রূপে পরিচিত। কেবলমাত্র কালিদাস নন, ভারতীয়দের হৃদয়ের গহনে বাল্মীকি ‘আদিকবি’ এবং রামায়ণ ‘আদিকাব্য' রূপে সমাদৃত।  ② সতীদাহ : রামায়ণ-এ সতীদাহ প্রথার উল্লেখ নেই, কিন্তু মহাভারতে পাণ্ডুর মৃত্যুর পর মাদ্রীর সহমরণের কথা বর্ণিত আছে। যেহেতু সতীদাহপ্রথা অনেক পরে প্রচলিত হয়েছিল, তাই রামায়ণ মহাভারত অপেক্ষা প্রাচীনতর। ③ অবতার : মহাভারতের শ্রীকৃয় বিষ্ণুর অষ্টম অবতার, যার আবির্ভাব দ্বাপর যুগে। অন্যদিকে ত্রেতা যুগে আবির্ভূত বিষ্ণুর সপ্তম অবতার হলেন রামায়ণের শ্রীরামচন্দ্র। এটিও রামায়ণের প্রাচীনত্বের দৃষ্টান্তস্বরূপ ④ আলৗকিকতা : মানুষ যত আধুনিক হয়েছে, সে ততই অলৌকিকতা ত্যাগ করেছে। তাই রামায়ণ-এ দশ স্কন্ধবিশিষ্ট রাবণ, বানরসৈন্য এবং লঙ্কাকাণ্ডের মতো অলৌকিক এবং অতিশয়োক্তি ঘটনার উল্লেখ থাকলেও মহাভারতে কোনো রূপ অলৌকিক ঘটনা স্থান পায়নি।

❐ মহাভারতের পক্ষে যুক্তি : উপরোক্ত  যুক্তিগুলিকে খণ্ডন করে ভিত্তারনিৎস (Winternitz) বলেছেন যে, রামায়ণের রচনাশৈলী মহাভারত অপেক্ষা অনেক উন্নত। এ ছাড়াও পরবর্তী কবিদের সৃষ্টি অলংকৃত কাব্যের অস্তিত্ব মহাভারতে চোখে না পড়লেও রামায়ণে তা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। গদ্য এবং পদ্যের মিশ্রণে গঠিত মহাভারতের অবয়ব এর প্রাচীনত্বের ধারণা দেয়। সর্বোপরি মহাভারতে যে হিংস্রতা, যুদ্ধপ্রিয়তা, আদিম প্রবৃত্তি দেখা গিয়েছিল, কালের গতিতে তা রামায়ণে অনেক স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল। সেই কারণে মূল রামায়ণ মূল মহাভারতের পরে রচিত হয়েছিল বলে মনে করা যায়।

❐ মূল্যায়ন : উভয় পক্ষের যুক্তিসমূহ আলোচনা করে বলা যায়, মহাভারতের রচনাকাল শেষ হওয়ার অনেক বছর পূর্বেই রামায়ণ তার পরিণত রূপ লাভ করেছিল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)