➺ খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের শুরুতে মক্কাবাসীদের প্রচলিত ধর্মীয় আচার-আচরণের সঙ্গে মহম্মদের ধর্মীয় মতের পার্থক্য দেখা দেয়। এই কারণে 622 খ্রিস্টাব্দে হজরত মহম্মদ ও তাঁর অনুগামীরা মক্কা থেকে মদিনা শহরে চলে আসেন। মহম্মদ এবং তাঁর অনুগামীদের মক্কা থেকে মদিনায় চলে যাওয়ার ঘটনাকেই আরবি ভাষায় হিজরত বলা হয়।
২. অল-বিরুনি কে ছিলেন?
➺ অল-বিরুনি : অল-বিরুনি ছিলেন একজন বিখ্যাত দার্শনিক ও গণিত বিষয়ে পণ্ডিত ব্যক্তি। তিনি গজনির সুলতান মাহমুদের সময় পর্যটক হিসেবে ভারতে আসেন। ভারতে তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কিতাব অল-হিন্দ' গ্রন্থ লেখেন। ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ।
৩. তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধের গুরুত্ব লেখো।
❏ তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধের গুরুত্ব : 1192 খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে মহম্মদ ঘোরি রাজপুত রাজা তৃতীয় পৃথ্বীরাজ চৌহানকে পরাজিত করেন। এই যুদ্ধের গুরুত্ব হল- ① দিল্লিতে সুলতানি শাসনের ভিত্তি স্থাপিত হয়। ② ভারতে প্রচলিত যুদ্ধপদ্ধতির থেকে তুর্কি যুদ্ধপদ্ধতি বহুগুণ এগিয়ে সেটি প্রমাণিত হয়। ③ রাজপুতদের অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে।
৪. খলিফা কাদের বলা হয়?
➺ হজরত মহম্মদের পরবর্তীকালে কে ইসলাম জগতে নেতৃত্ব দেবেন—এই প্রশ্ন উঠতে থাকে। এমন অবস্থায় হজরত মহম্মদের চারজন প্রিয় শিষ্য একে একে নেতা নির্বাচিত হন। এরা ছিলেন আবুবকর, ওমর, ওসমান এবং আলি। এদেরই ‘খলিফা’ বলা হয়। খলিফা হলেন ইসলামীয় জগতের ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক নেতা। খলিফা শব্দটি আরবি শব্দ যার অর্থ প্রতিনিধি বা উত্তরাধিকারী। খলিফার অধিকৃত অঞ্চলের নাম খিলাফৎ।
৫. শশাঙ্ক কে ছিলেন?
➺ প্রথম জীবনে শশাঙ্ক ছিলেন গুপ্ত সম্রাট মহাসেনগুপ্তের মহাসামন্ত। পরবর্তী জীবনে 606-607 খ্রিস্টাব্দের কিছু সময় পূর্বে তিনি স্বাধীন শাসক হয়ে গৌড়ের সিংহাসনে বসেন। শশাঙ্কের আমলে গৌড় রাজনৈতিকভাবে আরও গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হয়ে উঠেছিল। উত্তর ভারতের শক্তিশালী শাসক হর্ষবর্ধনের সঙ্গে তার শত্রুতার কথা সাহিত্যিক উপাদান থেকে জানা যায়। তিনি ছিলেন বাংলার প্রথম সার্বভৌম রাজা। শশাঙ্কের রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ।
৬. গৌড়তন্ত্র কী?
➺ শশাঙ্কের শাসনকালে গৌড়ে যে শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তাকে গৌড়তন্ত্র বলা হত। এই ব্যবস্থায় রাজ্যের আমলারা গ্রামের স্থানীয় প্রশাসনের কাজে হস্তক্ষেপ করতেন। আলোচ্য সময়ে গৌড়ে কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা চালু ছিল।
𒀭𒀭𒀭 Question Mark- 5
১. কৈবর্ত বিদ্রোহ সম্বন্ধে যা জানো লেখো।
অথবা, টীকা লেখো : কৈবর্ত বিদ্রোহ
➺ একাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বা আনুমানিক 1070-71 খ্রিস্টাব্দে পালরাজা দ্বিতীয় মহীপালের শাসনকালে কৈবর্ত বিদ্রোহ হয়েছিল।
① কৈবর্তদের পরিচয় ও বাসস্থান : কৈবর্তরা সম্ভবত নৌকার মাঝি বা জেলে ছিল। তখনকার বাংলার উত্তরভাগে বসবাসকারী কৈবর্তদের সেখানে বেশ প্রভাব ছিল।
② উপাদান : সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত' কাব্য থেকে কৈবর্ত বিদ্রোহের কথা জানা যায় বলে এটি এই বিদ্রোহের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে।
③ নেতা : কৈবর্ত বিদ্রোহের তিনজন নেতার কথা জানা যায়। তাঁরা হলেন দিব্য দিব্বোক, রুদোক এবং ভীম। এদের মধ্যে দিব্য বা দিব্বোক-এর নেতৃত্বে কৈবর্ত বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল।
④ বিদ্রোহের কারণ : কৈবর্ত বিদ্রোহের কারণ প্রসঙ্গে একাধিক মত রয়েছে। যেমন—অনেকের মতে পাল রাজা দ্বিতীয় মহীপালের অত্যাচারে ক্ষুদ্ধ হয়ে কৈবর্তরা বিদ্রোহ করেছিল। আবার অপর একটি মতানুযায়ী, পাল রাজাদের দুর্বলতার সুযোগে পাল রাষ্ট্রের কর্মচারী দিব্যর নেতৃত্বে কৈবর্তরা বিদ্রোহ করেছিল।
⑤ বিদ্রোহের পরিণাম : দ্বিতীয় মহীপাল বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে দিব্যর হাতে পরাজিত ও নিহত হন। দিব্য বরেন্দ্র অঞ্চল দখল করে সেখানকার রাজা হন। দিব্যর মৃত্যুর পর রুদোক এবং ভীম বরেন্দ্র অঞ্চল শাসন করেন। পাল শাসক রামপাল বরেন্দ্র অঞ্চল উদ্ধার করতে গিয়ে প্রথমে ব্যর্থ হলেও পরবর্তীকালে তিনি বাংলা এবং বিহারের বিভিন্ন সামন্ত নায়কদের সাহায্য নিয়ে ভীমকে পরাজিত ও হত্যা করে বরেন্দ্রভূমি পুনরুদ্ধার করে। এইভাবে কৈবর্ত বিদ্রোহের অবসান হয়।
❏ উপসংহার : কৈবর্ত বিদ্রোহ পাল শাসনের ভীত নড়িয়ে দিয়েছিল। এর ফলে পাল শাসনের দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
২. পাল রাজাদের সম্পর্কে যা জানো তা সংক্ষেপে তোমার নিজস্ব ভাষায় লেখার চেষ্টা করো।
➺ বাংলায় দীর্ঘ একশো বছরের মাৎস্যন্যায় অবস্থার অবসান ঘটিয়ে বাংলায় পাল শাসনের সূচনা হয়েছিল।
❏ পাল বংশের শাসক বর্গ :
① গোপাল : পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল তাঁর শাসনকালে (আনুমানিক 750-78 খ্রিস্টাব্দে) তিনি বাংলার অধিকাংশ অঞ্চলকে শাসনের আওতায় এনেছিলেন। তাঁর সব চেয়ে বড়ো কৃতিত্ব হল তিনি বাংলাকে মাৎস্যন্যায় মুক্ত করে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
② ধর্মপাল : গোপালের যোগ্য উত্তরাধিকারী ছিলেন ধর্মপাল। (আনুমানিক 774-836 খ্রিস্টাব্দ)। উত্তর ভারতের কনৌজকে কেন্দ্র করে যে ত্রিশক্তি সংগ্রাম চলেছিল তাতে অংশগ্রহণ করেছিলেন ধর্মপালের সাম্রাজ্য বাংলা থেকে জলন্ধর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
③ দেবপাল : ধর্মপালের পুত্র দেবপাল (আনুমানিক 806 – 45 খ্রিস্টাব্দ) উত্তর এবং দক্ষিণ ভারতে পাল সাম্রাজ্য বিস্তার করতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর শাসনকালে উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে দক্ষিণে বিন্ধ্যপর্বত পর্যন্ত এবং পূর্বে প্রাগজ্যোতিষপুর থেকে উত্তর-পশ্চিমে কম্বোজ পর্যন্ত পাল সাম্রাজ্য ছড়িয়ে পড়েছিল।
④ পরবর্তী পাল শাসকগণ : দেবপালের শাসনকালের পর থেকে (অর্থাৎ আনুমানিক 845 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) প্রথম মহীপালের সিংহাসন আরোহণের সময় (আনুমানিক 977 খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত পাল বংশের গৌরব অনেকটাই কমে গিয়েছিল। তবে প্রথম মহীপালের শাসনকালে (আনুমানিক 977-1027 খ্রিস্টাব্দ) পাল শাসকদের গৌরব অনেকটাই ফিরে আসে। এরপর দ্বিতীয় মহীপালের শাসনকালে কৈবর্ত বিদ্রোহের কারণে পাল বংশে যে সমস্যা দেখা দিয়েছিল তা পরবর্তী পাল শাসক রামপাল সমাধান করেছিলেন। রামপাল (শাসনকাল আনুমানিক 1072-1126 খ্রিস্টাব্দ) ওই বিদ্রোহের অবসান ঘটিয়ে বরেন্দ্রভূমি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন।
❏ উপসংহার : পাল শাসনকাল বাংলার ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায় সূচনা করেছিল। কিন্তু পাল শাসক রামপালের মৃত্যুর পরবর্তী পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই ওই বংশের পরবর্তী শাসকদের অযোগ্যতা ও দুর্বলতায় পাল বংশের পতন ঘটে।
৩. বাংলায় তুর্কি আক্রমণ সম্পর্কে মিনহাজ-ই-সিরাজ-এর বিবরণের সত্যতা সম্পর্কে লেখো। 18 জন ঘোড় সওয়ার কি সত্যিই রাজধানী নদিয়া জয় করেছিলেন?
➺ বাংলায় তুর্কি আক্রমণের (আনুমানিক 1204-05 খ্রিস্টাব্দ) প্রায় চল্লিশ বছর পর ঐতিহাসিক মিনহাজ-ই-সিরাজ বাংলায় এসেছিলেন। তখন বখতিয়ার খলজির অভিযানের কাহিনি লোকমুখে শুনে বাংলায় নদিয়ায় তুর্কি আক্রমণের কাহিনি লিখেছিলেন।
𒀭 বাংলায় তুর্কি আক্রমণ সম্পর্কে মিনহাজ -ই-সিরাজের বিবরণের সত্যতা যাচাই : ঐতিহাসিক বিবরণ সব সময় সত্য নাও হতে পারে। অনেক সময় লোকমুখে বিভিন্ন ঘটনা শুনে লেখকগণ সেগুলির সঙ্গে নিজের কল্পনা মিশিয়ে লিখে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। যেমন— মিনহাজ-ই-সিরাজ বখতিয়ার খলজির বাংলায় আক্রমণ প্রত্যক্ষ করেননি। কিন্তু তিনি বাংলায় তুর্কি আক্রমণের চল্লিশ বছর পর বাংলায় এসে লোকমুখে শুনে হয়তো নিজের মতো করে আক্রমণের বিবরণ লিখেছিলেন। তাঁর লেখা “তবাকাত-ই-নাসিরি' গ্রন্থ থেকে জানা যায়, নদিয়া আক্রমণের সময় বখতিয়ার খলজির সঙ্গে মাত্র 18 জন ঘোড়সওয়ার ছিলেন। তাই তাঁর এই বিবরণের সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ থেকে যায়।
𒀭 18 জন ঘোড়সওয়ার নিয়ে নদিয়া জয়ের সত্যতা : কথিত আছে, বখতিয়ার খলজির সঙ্গে মাত্র 18 জন ঘোড়সওয়ার ছিল এবং তাদের নিয়েই তিনি নদিয়া জয় করেছিলেন। কিন্তু এই ধারণা ঠিক নয়। কারণ সেখানে উত্তর ভারত থেকে বাংলায় আসার একাধিক রাস্তা ছিল। সাধারণত বিহার থেকে বাংলায় আসার সময় রাজমহল পাহাড়ের উত্তরদিকের পথ ধরেই আসতে হত। রাজা লক্ষ্মণসেনও ওই পথেই তুর্কি আক্রমণ ঠেকানোর জন্য তাঁর সৈন্য মোতায়েন করেছিলেন। কিন্তু বখতিয়ার খলজি তাঁর সৈন্যদের কয়েকটি ছোটো ছোটো দলে ভাগ করে বর্তমান ঝাড়খণ্ডের দুর্গম জঙ্গলের পথ দিয়ে বাংলায় এসেছিলেন। তাই তর্কিদের আসার কথা শুনে লক্ষ্মণসেন প্রতিরোধ না করে পূর্ববঙ্গের দিকে চলে যান। এমন অবস্থায় সুরক্ষিত না থাকা রাজধানী নদিয়া জয় করা বখতিয়ার খলজির পক্ষে সহজ হয়েছিল।
৪. গৌড়ের রাজা শশাঙ্কের কৃতিত্ব আলোচনা করো।
➺ শশাঙ্ক ছিলেন গুপ্ত শাসক মহাসেনগুপ্তের মহাসামন্ত। তিনি গৌড়ে একটি স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
𒀭 শশাঙ্কের কৃতিত্ব :
① স্বাধীন গৌড়ের প্রতিষ্ঠা : শশাঙ্কের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আনুমানিক 606 খ্রিস্টাব্দে গৌড়ে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়। সিংহাসন লাভের পর শশাঙ্ক দক্ষিণ বঙ্গ ও পূর্ববঙ্গ অধিকার করে সমগ্র বাংলায় তাঁর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। শশাঙ্কের আমলে গৌড় ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিল। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত শশাঙ্ক গৌড়ের স্বাধীন শাসক ছিলেন। তাঁর রাজধানীর নাম ছিল কর্ণসুবর্ণ।
② রাজ্য বিজেতা : শশাঙ্ক ছিলেন একজন রাজ্য বিজেতা। তাঁর শাসনকালে উত্তর ভারতের কনৌজ, মালব, স্থানীশ্বর (থানেশ্বর), কামরূপ, গৌড় প্রভৃতি আঞ্চলিক শক্তিগুলি নিজেদের স্বার্থে কখনও পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, বা মৈত্রীর সম্পর্ক বজায় রাখত। শশাঙ্কও সেই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। তিনি সমগ্র গৌড়দেশ, মগধ-বুদ্ধগয়া অঞ্চল এবং ওড়িশার কিছু অংশ নিজের অধিকারে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। উত্তর ভারতের ক্ষমতাশালী রাজ্যগুলির সঙ্গে সংগ্রাম করে তিনি গৌড়ের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছিলেন।
③ সামরিক দক্ষতা : বিভিন্ন রাজ্যজয় করে গৌড়ের সীমানাবৃদ্ধি তাঁর সামরিক দক্ষতা প্রমাণ করে। উত্তর ভারতের সেই সময়কার শক্তিশালী শাসক হর্ষবর্ধন পর্যন্ত শশাঙ্ককে হারাতে পারেননি।
④ ধর্মীয় ক্ষেত্র : ব্যক্তিগত জীবনে শশাঙ্ক শিবের উপাসক ছিলেন। তবে কোনো কোনো বৌদ্ধগ্রস্থ এবং চিনের পর্যটক সুয়ান জাৎ তাঁকে বৌদ্ধবিদ্বেষী বলেছেন। কিন্তু শশাঙ্কের মৃত্যুর পরবর্তী সময় বাংলায় বৌদ্ধধর্মের উন্নতি চোখে পড়ায় তাঁকে বৌদ্ধবিদ্বেষী বলা অতিরঞ্জিতই মনে হয়েছে।
⑤ সুশাসক : শশাঙ্কের শাসনকালে গৌড়ের শাসনব্যবস্থা ‘গৌড়তন্ত্র' নামে পরিচিত। এই ব্যবস্থায় শশাঙ্ক তাঁর রাজ্যের কর্মচারী বা আমলাদের দ্বারা একটা নির্দিষ্ট শাসন প্রণালী গড়ে তুলেছিলেন। শশাঙ্কের আমলে গৌড়ে সরকার পরিচালনা করা হত কেন্দ্ৰীয়ভাবে।
❏ উপসংহার : শশাঙ্কের সুদক্ষ নেতৃত্ব, পরাক্রম ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে বাংলা একটি শক্তিশালী সর্বভারতীয় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার যথার্থই বলেছেন, “বাঙালি রাজাদের মধ্যে সর্বপ্রথম সার্বভৌম নরপতি ছিলেন শশাঙ্ক।”
৫. টীকা লেখো : কর্ণসুবর্ণ।
অথবা, প্রাচীনকালে বাংলার কর্ণসুবর্ণ নগর প্রসঙ্গে কী জানো?
➺ শশাঙ্কের শাসনকালে প্রাচীন গৌড়ের রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ। কর্ণসুবর্ণ স্থানীয় ভাবে 'কানসোনা' নামেও পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গের মুরশিদাবাদ জেলার চিরুটি রেল স্টেশনের কাছাকাছি অঞ্চলটি কর্ণসুবর্ণ নামে পরিচিত ছিল। স্থানীয়ভাবে এটিকে 'রাজা কর্ণের প্রাসাদ' নামেও উল্লেখ করা হয়।
① প্রাচীন ঐতিহাসিক প্রত্নস্থল : মুরশিদাবাদের চিরুটি রেলস্টেশনের কাছে রাজবাড়িডাঙায় প্রাচীন রক্তমৃত্তিকা বা রাঙামাটিতে বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। চিনের পর্যটক সুয়ান জাং (হিউয়েন সাঙ)-এর বর্ণনায় এটির উল্লেখ আছে। এই বৌদ্ধ বিহারটিকে চিনা ভাষায় লো-টো-মো-চিহ্ব লা হয়েছে। প্রাচীন এই ঐতিহাসিক প্রত্নস্থলটির নিকটবর্তী স্থানই ছিল কর্ণসুবর্ণ।
② বৈশিষ্ট্য : সুয়ান জাং-এর বিবরণ থেকে জানা যায়, কর্ণসুবর্ণ অঞ্চলটি ছিল জনবহুল। সেখানকার জমি নীচু ও আর্দ্র, জলবায়ু ছিল নাতিশীতোষ্ণ। কর্ণসুবর্ণে নিয়মিত কৃষিকাজ চলত, প্রচুর ফলমূল হত। সেখানকার মানুষেরা অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং চরিত্রবান ছিলেন। তারা শিক্ষাদীক্ষার পৃষ্ঠপোষকতাও করতেন। কর্ণসুবর্ণে বৌদ্ধ এবং শৈব-উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই বসবাস বাণিজ্য ও প্রশাসনিক কেন্দ্র : সেকালে কর্ণসুবর্ণ বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। পার্শ্ববর্তী গ্রামের সঙ্গে এখানকার নাগরিকদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের আদানপ্রদান হত। শশাঙ্কের আমলের থেকেই সম্ভবত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে এই অঞ্চলের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। কর্ণসুবর্ণ গৌড়ের রাজধানী হওয়ায় প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
③ রাজনৈতিক পালাবদল : কর্ণসুবর্ণের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বারবার পালাবদল ঘটতে দেখা গেছে। শশাঙ্কের মৃতুর পর স্বল্প সময়ের জন্য এটি কামরূপের রাজা ভাস্করবর্মা দখল করেন। এরপর কিছু সময় এটি ছিল নাগ শাসক জয়নাগের রাজধানী।
❏ উপসংহার : শশাঙ্কের পরবর্তী সময়ে কর্ণসুবর্ণের গুরুত্ব হ্রাস পায়। সপ্তম শতকের পরবর্তীকালে এটির কথা আর বিশেষ কিছু জানা যায় না। পাল ও সেন যুগের ঐতিহাসিক উপাদানগুলিতেও এটির কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না।