১. 'উর' এবং 'নাড়ু' বলতে কী বোঝো? এদের কাজ কী ছিল?
➺ দক্ষিণ ভারতে চোল রাজাদের শাসনব্যবস্থায় দুটি স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনমূলক সংস্থা ছিল ‘উর’ এবং ‘নাড়ু’। চোল শাসনকালে কৃষকদের বসতিকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল গ্রাম। গ্রামকে শাসন করত যে গ্রাম পরিষদ, তাকে ‘উর' বলা হত।
➺ কৃষকদের বসতিকে ঘিরে গড়ে ওঠা কয়েকটি গ্রামকে একত্রে ‘নাড়ু’ বলা হত। ‘উর’ ও ‘নাড়ু’ চোল শাসনব্যবস্থায় স্বায়ত্তশাসন, বিচার, ও রাজস্ব (Tax) সংগ্রহের দায়িত্ব পালন করত।
২. 'ব্রহ্মদেয়' ও 'নগরম' কী ছিল?
➺ দক্ষিণ ভারতে চোল শাসনকালে কৃষিজমির পরিমাণ বৃদ্ধি করার জন্য অনেক ক্ষেত্রে ব্রাক্ষ্মণদের কিছু জমি দান করা হত। ব্রাহ্মণদের দান করা ওই জমি থেকে কোনো কর বা রাজস্ব নেওয়া হত না। এইরূপ নিষ্কর জমিকে আলোচ্য সময়ে 'ব্রহ্মদেয়' বলা হত।
নগরম : চোল শাসনকালে ব্যাবসায়ীদের নিরাপত্তা, তাদের বিভিন্ন সমস্যার মোকাবিলা ও ব্যাবসায়িক স্বার্থ রক্ষার জন্য 'নগরম' নামক পরিষদ গড়ে উঠেছিল।
৩. সামন্ততন্ত্র বলতে কী বোঝায়?
➺ মধ্যযুগের ভারতে এক বিশেষ গোষ্ঠীর রাজকর্মচারীদের নগদ বেতনের বদলে জমি দেওয়া হত। এই রাজকর্মচারীদের প্রত্যেকে এক-একটি অঞ্চলের অধিপতি হত। তারা গ্রাম থেকে রাজস্ব আদায়ের পাশাপাশি গ্রামের শাসন এবং বিচারকার্যেরও দেখাশোনা করত। নিজেরা কোনো পরিশ্রম না করে অন্যের শ্রমের ফল ভোগ করত। এইভাবে গড়ে-ওঠা ব্যবস্থাই সামন্ততন্ত্র নামে পরিচিত।
৪. নির্বাণ কী?
➺ নির্বাণ শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘নিভে যাওয়া’। তবে বৌদ্ধধর্মে নির্বাণ বলতে মোক্ষ বা মুক্তি বোঝায়। বৌদ্ধ ধর্মমতে নির্বাণ লাভ করলে বারবার মানুষকে জন্মাতে হয় না। কুষাণ শাসক কনিষ্কের সভাকবি অশ্বঘোষের ধারণা অনুযায়ী প্রদীপের তেল ফুরিয়ে গেলে যেমন তার শিখা নিভে যায়, তেমনি জীবনে দুঃখের অবসান ঘটলে নির্বাণ বা মুক্তিলাভ হয়। নির্বাণ হল প্রকৃতপক্ষে এমন এক অবস্থা যেখানে শোক-দুঃখ, কামনা-বাসনা, জরা, ব্যধি, মৃত্যু প্রভৃতি থেকে চিরকালের জন্য মুক্তি লাভ করা যায়।
৫. টীকা লেখো : চর্যাপদ।
➺ খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ চর্যাপদ লিখেছিলেন। এটি প্রকৃতপক্ষে কবিতা ও গানের সংকলন। বাংলা ভাষার আদিমতম নিদর্শন হল চর্যাপদ। 1907 খ্রিস্টাব্দে নেপালের রাজদরবার থেকে চর্যাপদের পুঁথি আবিষ্কার করেন পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। চর্যাপদের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য কবি হলেন-লুইপাদ, কাহ্নপাদ, ভুসুকুপাদ, ঢেনঢন পাদ প্রমুখ।
৬. টীকা লেখো : নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় (মহাবিহার)।
① নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়-এর অবস্থান : প্রাচীন ভারতের মগধ রাজ্যে (বর্তমানে বিহারের রাজগির) অবস্থিত একটি খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় (মহাবিহার) ছিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। এটি প্রাচীন ভারতের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাকেন্দ্র ছিল। ② প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতি : গুপ্ত সম্রাটদের শাসনকালে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে বর্তমান বিহার রাজ্যের রাজগিরে নালন্দা বৌদ্ধবিহার গড়ে উঠেছিল। ধীরে ধীরে সমগ্র এশিয়ায় নালন্দা শিক্ষাদীক্ষার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে হর্ষবর্ধন ও পাল রাজাদের আমলে এই মহাবিহার শাসকদের আর্থিক সাহায্য পেয়েছিল। স্থানীয় রাজা, জমির মালিক ছাড়াও সুমাত্রা দ্বীপের শাসকও এই মহাবিহারে সম্পদ প্রদান করেন। ③ সুবিধা প্রদান : নালন্দা মহাবিহারে ছাত্রদের নিখরচায় খাদ্য, জামাকাপড়, শষ্যদ্রব্য এবং ওষুধপত্র দেওয়া হত। ④ প্রবেশিকা পরীক্ষা : বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছাত্ররা এখানে পড়তে আসত। তবে কঠিন প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করার পর ছাত্ররা এখানে পড়ার সুযোগ পেত। নালন্দা মহাবিহারের পাঠ্য বিষয়গুলির মধ্যে ছিল বৌদ্ধশাস্ত্র, দর্শন, যুক্তিশাস্ত্র, গণিত, বেদ, ব্যাকরণ, আয়ুর্বেদ শাস্ত্র, জেতিষশাস্ত্র প্রভৃতি।
সুদূর চিন, ভিকাত, মধ্য এশিয়া, কোরিয়া মোঙ্গোলিয়া থেকে ছাত্ররা এখানে পড়তে আসত বলে এর আন্তর্জাতিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। সমৃদ্ধির যুগে নালন্দায় প্রায় 1500 শিক্ষক এবং 8500 জন ছাত্র ছিল।
৭. ধীমান ও বীটপাল কে ছিলেন?
➺ বরেন্দ্রভূমির ধীমান ও বীটপাল ছিলেন পাল যুগের দুজন বিখ্যাত শিল্পী। খ্রিস্টীয় অষ্টম-নবম শতকের অসামান্য শিল্পী ছিলেন ধীমান। বীটপাল ছিলেন ধীমানের পুত্র। ধীমান ও বীটপাল—দুই শিল্পীই ধাতব, ভাস্কর্য এবং চিত্রশিল্পে অসামান্য অবদান রেখে যান।
৮. চর্যাপদ কেন পাল আমলের বাংলার সামাজিক ইতিহাসের উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়?
➺ চর্যাপদে বাংলার সমাজজীবনের বিভিন্ন চিত্র ফুটে ওঠে। খেয়া পারাপার, পারিবারিক জীবনের কাহিনি, দারিদ্রতা প্রভৃতি সমাজচিত্র সুন্দরভাবে চর্যাপদে তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া সেই সময়কার সমাজে উচ্চবর্ণ, ধনীদের জীবনযাত্রা, বাসস্থান কীরূপ ছিল তাও এটি থেকে জানতে পারা যায়। এর পাশাপাশি সমাজের ডোম, ব্যাধ, তাঁতি প্রভৃতি শ্রেণির জীবনযাত্রা এবং উচ্চবর্ণ, ধনী প্রভৃতিদের সঙ্গে তাদের জীবনধারনের পার্থক্যও চর্যাপদে উঠে এসেছে। এইসব কারণে চর্যাপদ বাংলার সামাজিক ইতিহাসের উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
৯. ভারতে সামন্তব্যবস্থার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো।
➺ প্রাচীন ভারতবর্ষে জমির সঙ্গে সম্পর্কিত এবং আঞ্চলিকভাবে প্রভাবসম্পন্ন গোষ্ঠী সামন্ত নামে পরিচিত ছিল। তাদের পরিচালিত ভূমিব্যবস্থাই সাধারণভাবে সামন্তব্যবস্থা নামে পরিচিত।
𒀭 ভারতে সামন্তব্যবস্থার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য : ① ভারতে সামন্তদের মধ্যে অনেক ছিল উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী। এরা বেতনের পরিবর্তে অনেক সময় জমি পেত। ② সামন্তদের আয়ের প্রধান উৎস ছিল জমির রাজস্ব। ③ সামন্তরা অনেক সময় যুদ্ধে রাজাকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করত। ④ ব্রাক্ষ্মণ অথবা মন্দিরের প্রধানরা নিষ্কর জমি ভোগ করতে করতে সামন্তপ্রভুতে পরিণত হত। ⑤ রাজা দুর্বল হলে সেই সুযোগে অনেক সময় সামন্তরা স্বাধীন হওয়ার জন্য বিদ্রোহ করত।
১০. ভারতে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার দুটি ফলাফল লেখো।
➺ ভারতে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার ফলাফল ছিল প্রকৃতপক্ষে নেতিবাচক। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দুটি ফলাফল হল— ① পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা : ভারতে সামন্তরা নিজেদের ক্ষমতাবৃদ্ধি ঘটাতে প্রায়শই একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতেন। ফলে প্রায়ই সামন্তদের মধ্যে যুদ্ধ দেখা দিত। ② রাজস্ব আদায়ে কঠোরতা : ভারতে সামন্তরা জমি থেকে রাজস্ব আদায় করে রাজাকে দিত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাজার নির্ধারিত রাজস্বের অতিরিক্ত আদায় করতে কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ সত্ত্বেও রাজস্ব আদায় করতে সামন্তরা কঠোরতা অবলম্বন করত। ফলে কৃষকদের অবস্থা হয়ে ওঠে শোচনীয়।
১১. টীকা লেখো : দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান (অতীশ)।
𒀭 দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান (অতীশ) : বাঙালি বৌদ্ধ আচার্যদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত এবং শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ছিলেন দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। ওদন্তপুরী বিহারে আচার্য শীলরক্ষিতের কাছে দীক্ষা নিয়ে তিনি দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান নামে পরিচিত হন। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল অতীশ। আনুমানিক 980 খ্রিস্টাব্দে বঙ্গাল অঞ্চলের বিক্রমণিপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ব্রাক্ষ্মণ্য মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না, তাই তাঁর বাড়ি আজও 'নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা' নামে পরিচিত।
অতীশ সম্ভবত বিক্রমশীল, ওদন্তপুরী এবং সোমপুরি মহাবিহারের আচার্য ও অধ্যক্ষ ছিলেন। দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান (অতীশ) ছিলেন বিরল প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব। তিনি মাত্র তিন বছর বয়সে সংস্কৃত ভাষা পাঠ করতে এবং দশ বছর বয়সে কোনটি বৌদ্ধ এবং কোনটি অ-বৌদ্ধ শাস্ত্র সেটি বুঝতে শিখেছিলেন। তাঁর প্রতিভা লক্ষ করে বৌদ্ধ পণ্ডিত জেত্রির পরামর্শ মেনে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান শাস্ত্র শিক্ষা গ্রহণ করতে নালন্দায় যান। তাঁর ছেলেবেলার নাম চন্দ্রগর্ভ। বারো বছর বয়সে নালন্দায় শিক্ষাগ্রহণ করার সময়কালে সেখানকার আচার্য বোধিভদ্র তাঁর নামকরণ করেন দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান।
তিব্বতের রাজা জ্ঞানপ্রভের আমন্ত্রণে তিনি দুর্গম হিমালয় পর্বত অতিক্রম করে সম্ভবত 1040 খ্রিস্টাব্দে তিব্বতে যান। সেখানে তিনি মহাযান বৌদ্ধধর্মের প্রচার করেন। তিব্বতে বৌদ্ধধর্মকে জনপ্রিয় করতে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। তিনি একাধিক সংস্কৃত গ্রন্থ ভোট ভাষায় অনুবাদ করেন। দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান তিব্বতে বুদ্ধের অবতার হিসেবে পূজিত হন। তিব্বতের রাজধানী লাসার কাছে তাঁর সমাধিস্থান পবিত্র তীর্থক্ষেত্র হিসেবে গণ্য হয়।
১২. বিক্রমশীল মহাবিহারের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
➺ পাল রাজা ধর্মপাল খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে তৎকালীন মগধ রাজ্যের উত্তর অংশে গঙ্গার তীরবর্তী স্থানে আধুনিক ভাগপুর শহরের কাছে বিক্রমশীল মহাবিহার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান (অতীশ) ছিলেন এই মহাবিহারের অন্যতম মহাচার্য। এই মহাবিহার বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে ভরতি হতে হত। এখানে সর্বাধিক প্রায় তিন হাজার ছাত্রকে বিনা খরচে পড়ানো হত। বিক্রমশীল মহাবিহারে তর্কশাস্ত্র, দর্শন, ব্যাকরণ, গণিত, চিকিৎসাবিদ্যা পড়ানো হত। এই মহাবিহারে বৌদ্ধ ধর্মচর্চা ও শিক্ষার জন্য একশোর বেশি আচার্য ছিলেন। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের পরবর্তী পাঁচশো বছর এই মহাবিহারের স্থায়িত্ব ছিল। ত্রয়োদশ শতকে তুর্কি আক্রমণকারীদের দ্বারা এই মহাবিহার ধ্বংস হয়।
১৩. পাল আমলে শিল্পচর্চা সম্পর্কে লেখো।
➺ পাল যুগের শিল্পরীতিকে প্রাচ্য শিল্পরীতি বলা হয়। এই রীতির পূর্বসূরি হিসেবে গুপ্ত যুগের শিল্পকলার কথা উল্লেখ করতে হয়। পাল আমলের স্থাপত্যের মধ্যে ছিল স্তূপ, বিহার, এবং মন্দির পাল আমলের স্তূপগুলি শিখরের মতো দেখতে ছিল। বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকার আসরাফপুরে রাজশাহির পাহাড়পুরে, চট্টগ্রামে, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার ভরতপুরে পাল আমলের স্থাপত্য পাওয়া গেছে। সোমপুর বিহার পাল আমলের অন্যতম স্থাপত্য । পাল আমলের ভাস্কর্য নির্মাণে পাহাড়পুরের অবদান উল্লেখ করার মতো। পাল আমলের ভাস্কর্যগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মন্দিরগাত্রে পোড়ামাটির কাজ। এগুলি থেকে সেই সময়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ও ধর্মবিশ্বাসের পরিচয় পাওয়া যায়।
১৪. বাংলায় সেন যুগে ‘পঞ্চরত্ন' বলতে কাদের বোঝানো হত?
➺ বাংলায় সেন রাজা লক্ষণসেনের রাজসভায় পাঁচজন কবি উল্লেখযোগ্য ছিলেন। এই পাঁচজন কবি একত্রে ‘পঞ্চরত্ন' বলে অভিহিত হতেন। বিখ্যাত এই পাঁচজন কবি হলেন—জয়দেব, ধোয়ী, উমাপতিধর, গোবর্ধন ও শরণ।
১৫. আঙ্কোরভাটের বিষ্ণু মন্দির সম্পর্কে কী জানো?
➺ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কম্বোডিয়ায় আঙ্কোরভাটে অবস্থিত বিষ্ণু মন্দিরটি সমগ্র বিশ্বে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। দ্বাদশ শতকের প্রথমার্ধে এই বিখ্যাত বিষ্ণু মন্দিরটি তৈরি হয়। নয়টি চূড়া এবং 213 মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট এই মন্দিরের গায়ে রামায়ণ ও মহাভারতের নানান কাহিনি খোদাই করা আছে। এটি প্রকৃতপক্ষে বিয়ুমন্দির হলেও পরে এখানে বৌদ্ধরাও উপাসনা করত বলে জানা যায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয় সংস্কৃতি প্রসারের এটি একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন।
𒀭𒀭𒀭 Question Mark- 5
১. সামন্ত ব্যবস্থা বলতে কী বোঝো? ভারতে কীভাবে সামন্ত ব্যবস্থার উত্থান হয়?
❏ সামন্ত ব্যবস্থা : মধ্যযুগের ভারতে এক বিশেষ শ্রেণির রাজকর্মচারী ছিল যাদের বেতনের পরিবর্তে জমি দেওয়া হত। এরা একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের রাজস্ব আদায় করত এবং গ্রামের শাসন ও বিচারকার্য দেখাশোনা করত। রাজার কাছ থেকে জমি প্রাপকরা সামন্ত নামে পরিচিত হতেন। সামন্তরা উপসামত্ত ও সাধারণ জনগণকে নিয়ে যে ব্যবস্থা পরিচালনা করত তা সামস্ত ব্যবস্থা নামে পরিচিত।
❏ ভারতে সামন্ত ব্যবস্থার উদ্ভবের কারণ : ভারতে সামন্ত ব্যবস্থা উদ্ভবের কয়েকটি কারণ ঐতিহাসিকরা চিহ্নিত করেছেন। যেমন- ① কৃষির গুরুত্ব বৃদ্ধি : খ্রিস্টীয় সপ্তম শতক থেকে ভারতের বেশ কিছু স্থানে ব্যাবসাবাণিজ্যে মন্দা দেখা দিয়েছিল। ফলে সমাজে জমি ও কৃষির গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। রাজা নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত জমির রাজস্ব পাওয়ার শর্তে সামন্তদের জমি দিতেন। জমি ও কৃষিকে কেন্দ্র করে এভাবে সামন্ত ব্যবস্থার উদ্ভব হয়। ② আঞ্চলিক শক্তির উত্থান : খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে আঞ্চলিক শক্তির বাড়বাড়ন্ত ভারতে সামন্ত ব্যবস্থার উত্থান ও বিকাশে সহায়ক হয়েছিল। আঞ্চলিক শাসক রাজা অধীন সামন্তরা ছিল রাজা ও কৃষকদের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত একটি শ্রেণি। আঞ্চলিক শাসকদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহায়তায় সামন্তদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। ③ সামন্ত রাজ্যে পরিণতকরণ : অনেক সময় যুদ্ধজয়ী রাজা পরাজিত রাজ্য দখল না করে কর প্রদানের শর্তে তাকে করদ রাজ্যে পরিণত করত। ওই শর্তে রাজি হওয়া পরাজিত রাজা হয়ে যেত যুদ্ধ জয়ী রাজার সামন্ত এবং তার রাজ্যটি সামস্ত রাজ্যে পরিণত হত। তখন ওই সামন্ত রাজ্যে গড়ে ওঠা শাসনব্যবস্থাই সামন্ত ব্যবস্থা হিসেবে পরিচিত হত।
২. ভারতে সামন্ততন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলির উল্লেখ করো।
❏ ভারতে সামন্ততন্ত্র : মধ্যযুগের ভারতে সামন্ততন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। জমির ওপর নির্ভর করে সামন্ত শ্রেণির দ্বারাই এই আর্থসামাজিক ব্যবস্থাটি গড়ে উঠেছিল।
❏ বৈশিষ্ট্যসমূহ : ভারতে সামন্ততন্ত্র বা সামন্ত তান্ত্রিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলি ছিল — ① বিভিন্ন স্তর : ভারতে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার বিভিন্ন স্তর লক্ষ করা যায় ৷ এই স্তরের উচ্চে রাজা এবং নিম্নে ভূমিদাস ও কৃষকদের মধ্যবর্তী স্তরে থাকত সামন্তরা। ② রাজস্ব আদায় : রাজা কর্তৃক নির্দিষ্ট শর্তে নিযুক্ত সামন্তরা তাদের নির্দিষ্ট অঞ্চল থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করত। ওই সংগৃহীত রাজস্বের নির্দিষ্ট অংশ রাজাকে দিত। এবং বাকি অংশ নিজেরা ভোগ করত। ③ সৈন্য সাহায্য : অনেক সময় রাজায় রাজায় যুদ্ধ হলে সামন্তরা তাদের রাজাকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করত। এর ফলে রাজা ও সামন্তদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠত। ④ রাজার বিরোধিতা : সামন্তরা সকল সময়ই যে তার রাজার প্রতি অনুগত থাকত বা রাজাকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করত তা নয়। কোনো কোনো সময় রাজা দুর্বল চরিত্রের হলে সামত্তরা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করত। ⑤ ভূমিদাস ও কৃষকদের প্রতি অত্যাচার : অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজারা সামন্তদের যে পরিমাণ রাজস্ব প্রদান করতে বলত সামন্তরা তার বেশি পরিমাণ রাজস্ব আদায় করার চেষ্টা করত। এর জন্য সামন্তরা ভূমিদাস ও কৃকেদের ভয় দেখাত, তাদের ওপর অত্যাচার করত।
৩. দক্ষিণ ভারতে চোল শাসনব্যবস্থা প্রসঙ্গে লেখো।
❏ দক্ষিণ ভারতে চোল শাসনব্যবস্থা : দক্ষিণ ভারতে চোল রাজারা খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত শাসন করেছিল। সেই কারণে চোল রাজাদের শাসনকালকে দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসের সুবর্ণ যুগ হিসেবে মনে করা হয়। ওই সময়কালে দক্ষিণ ভারতের চোল রাজাদের শাসনব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য দিকগুলি ছিল— ① শাসনব্যবস্থার প্রধান রাজা : রাজা ছিলেন চোল শাসনব্যবস্থার প্রধান। অর্থাৎ রাজার নির্দেশ অনুসারেই সমগ্র শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হত। সাধারণত রাজা বংশানুক্রমিকভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। রাজার শাসনকার্য পরিচালনার অন্যতম দুটি ক্ষেত্র ছিল শাস্ত্রীয় নিয়মকানুন এবং প্রচলিত সংস্কার। ② মন্ত্রী পরিষদ : চোল রাজাদের শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে সকলপ্রকার সহায়তা প্রদান করত মন্ত্রীপরিষদ। তারা রাজাকে বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করতেন । ③ রাজকর্মচারী : রাজার শাসনব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য রাজকর্মচারীদের নিয়োগ করা হত। রাজকর্মচারীরা বেতন হিসেবে জমি পেতেন। যেসব রাজকর্মচারী অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিতেন রাজারা তাঁদের পুরস্কার হিসেবে উপাধি প্রদান করতেন । ④ প্রশাসনিক বিভিন্ন বিভাগ : চোল শাসনব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত ছিল প্রশাসনিক বিভিন্ন বিভাগ। চোল সাম্রাজ্য গঠিত ছিল মূলত গ্রাম, জেলা অঞ্চল এবং প্রদেশ নিয়ে। কয়েকটি গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠত জেলা বা ‘নাড়ু’। আবার কয়েকটি জেলা নিয়ে গঠিত হত অঞ্চল বা ‘কোট্টম'। কতগুলি অঞ্চল নিয়ে প্রদেশ গঠিত হত।
৪. পাল ও সেন যুগের বাংলার অর্থনীতি কীরূপ ছিল?
❏ পাল ও সেন যুগে বাংলার অর্থনীতি : পাল ও সেন শাসনকালে বাংলার অর্থনীতি প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে কয়েকটি ক্ষেত্রের উল্লেখ করতে হয়। ক্ষেত্রগুলি হল—কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য এবং মুদ্রা। ① কৃষি : গাঙ্গেয় সমভূমিতে অবস্থিত বাংলা প্রাচীনকাল থেকেই একটি কৃষিপ্রধান অঞ্চল রূপে পরিচিত। ধান, পাট, তুলা, আখ, নারকেল, সুপারি ছিল সেই সময়কার উল্লেখযোগ্য ফসল। পাল ও সেন যুগে অধিকাংশ মানুষ ছিল কৃষিজীবী। ② শিল্প : পাল ও সেন যুগের কুটিরশিল্প বেশ উন্নতি লাভ করেছিল। এ ছাড়া এসময়ের বাংলার অর্থনীতিতে দেশে-বিদেশে বাংলার কুটিরশিল্পের বেশ চাহিদাও ছিল। বিশেষ করে বস্ত্রশিল্প, মৃৎশিল্প, ধাতুশিল্প, হস্তশিল্পের গুরুত্ব ছিল। ③ বাণিজ্য : বাংলার মসলিন (একপ্রকার সূক্ষ্মবস্ত্র) তখন বিদেশে রপ্তানি হত । তা ছাড়া এ অঞ্চলের গুড় ও চিনির চাহিদা বিদেশেও ছিল। এই সমস্ত কারণে পাল ও সেন যুগের বৈদেশিক বাণিজ্য বেশ উন্নতি লাভ করেছিল। তবে আরব বণিকদের প্রাধান্যের কারণে পরবর্তীকালে বাংলার বাণিজ্যিক গুরুত্ব কমে গিয়েছিল। ④ মুদ্রা : অর্থনীতির অন্যতম সূচক হল মুদ্রা। পাল আমলে বাংলায় সোনা-রুপোর মুদ্রার ব্যবহার কমে গিয়ে সেন আমলে ‘পুরাণ’ ও ‘কপর্দক পুরাণ' নামে দুই ধরনের মুদ্রা চলত। তবে কড়ি দিয়ে জিনিস কেনাবেচা হত।
৫.পাল ও সেন যুগে সাহিত্যচর্চার পরিচয় দাও।
❏ পাল যুগের সাহিত্যচর্চা : পাল যুগের সাহিত্য বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ছিল। সেগুলির মধ্যে উল্লেখ্য হল –① সংস্কৃত ভাষায় প্রাধান্য : পাল আমলে সাহিত্য, দর্শন, ব্যাকরণ রচনার ক্ষেত্রে রচনাকাররা প্রধানত সংস্কৃত ভাষাকে প্রাধান্য দিত। তবে সংস্কৃত ভাষায় রচিত সাহিত্য সাধারণ মানুষদের পাঠ করতে সমস্যা হত। ② বাংলা ভাষার উৎপত্তির সময়কাল : পাল আমলেই বাংলা ভাষার উৎপত্তির সময়কাল বলে অনেকে মনে করেন আনুমানিক 800-1100 খ্রিস্টাব্দ সময়কালে মাগধী অপভ্রংশ ভাষার গৌড়বঙ্গীয় রূপই পরবর্তীকালে প্রাচীন বাংলা ভাষার জন্ম দেয়। সেটিই ছিল তৎকালীন সাধারণ মানুষের ভাষা ৷ ③ রচিত উল্লেখযোগ্য সাহিত্য : পাল আমলে রচিত উল্লেখযোগ্য সাহিত্য ছিল–সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত’, চক্রপাণি দত্তের ‘চিকিৎসাসংগ্রহ', জীমূতবাহনের ‘দায়ভাগ' প্রভৃতি।
❏ সেন যুগের সাহিত্যচর্চা : সেন যুগের সাহিত্যও ছিল যথেষ্ট বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ৷ ওই বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে উল্লেখ্য হল— ① সংস্কৃত ভাষায় সাহিত্য রচনায় উৎসাহ : সেন আমলে রাজারা সংস্কৃত ভাষায় সাহিত্যে রচনায় লেখকদের উৎসাহ দিতেন। সেন রাজা বল্লালসেন নিজে ‘দানসাগর’ ও ‘অদ্ভুতসাগর' নামে দুটি গ্রন্থ রচনা করেন ৷ ② পঞ্চরত্নের উপস্থিতি : সেন রাজা লক্ষণসেনের রাজসভায় পাঁচজন বিখ্যাত কবি উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা হলেন—জয়দেব, ধোয়ী, উমাপতিধর, গোবর্ধন ও শরণ। এদের একত্রে ‘পঞ্চরত্ন' বলা হয়। ③ রচিত উল্লেখযোগ্য সাহিত্য : সেন আমলে রচিত উল্লেখযোগ্য সাহিত্য ছিল—জয়েদেবের ‘গীতগোবিন্দম্, ধোয়ীর ‘পবনদূত’ উমাপতিধরের ‘দেওপাড়া প্রশস্তি”, গোবর্ধনের ‘আর্যসপ্তশতী' প্রভৃতি।
৬. খ্রিস্টীয় সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ প্রসঙ্গে লেখো।
➺ খ্রিস্টীয় সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। এই যোগাযোগ গড়ে ওঠার ক্ষেত্রগুলি বিভিন্ন ছিল। আলোচ্য সময়কালে বিভিন্নভাবে এই যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল।
❏ খ্রিস্টীয় সপ্তম দ্বাদশ শতকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ : ① যোগাযোগের পথ : ভারত মহাসাগরকে কেন্দ্র করে জলপথে আলোচ্য সময়কালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। ② যোগাযোগের সূত্র : ওই সময়কালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগের সূত্র ছিল বাণিজ্য, ধর্মপ্রচার, রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। তামিলনাড়ুর মুসলিপত্তম এবং বাংলার তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে বণিকরা বাণিজ্যের সূত্রে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ‘সুবর্ণভূমি' (মালয়, বোর্নিও, সুমাত্রা, জাভা এবং পার্শ্ববর্তী দ্বীপ)-তে যাতায়াত করত। ধর্মপ্রচার বিশেষত বৌদ্ধধর্ম প্রচারের মাধ্যমেও এই যোগাযোগের সূত্র রচিত হয়েছিল। কম্বোজ, চম্পা ইত্যাদি প্রাচীন ভারতের অনেক রাজ্যের শাসক রাজনৈতিক আধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে অভিযান করেছিলেন। ③ যোগাযোগের সাংস্কৃতিক প্রভাব : প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাব পড়েছিল। কম্বোডিয়ায় রামায়ণের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে নৃত্য-সংগীত আলোচ্য সময়ে খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ④ যোগাযোগের তাৎপর্য : দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ আলোচ্য সময়ে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। ওই দেশগুলির শিল্প, লিপি, ভাষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে, ভারতের অনেক প্রভাব লক্ষ করা যায়। কম্বোডিয়ার আঙ্কোরভাটের বিখ্যাত বিষ্ণু মন্দিরের গায়ে ভারতের দুই মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারতের বিভিন্ন গল্প খোদাই করা এই প্রভাবেরই ফল বলে মনে করা হয় । ⑤ অন্য ক্ষেত্র : দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ গড়ে ওঠায় ভারতের কৃষিক্ষেত্রও উপকৃত হয়েছিল। ওই দেশগুলি থেকেই ভারত শিখেছিল পানপাতা এবং অন্যান্য কয়েকটি ফসল কীভাবে ফলাতে হয়।