লালন শাহ ফকিরের গান প্রশ্ন ও উত্তর

Esita Afrose
0
 লালন শাহ ফকিরের গান একাদশ শ্রেণি দ্বিতীয় সেমিস্টার বাংলা

❐ কবিতা লালন শাহ্ ফকিরের গান বিষয়সংক্ষেপ :
বাউল সাধক ও মরমি কবি ফকির লালন শাহের গান মূলত আত্মতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, জাতিভেদ বিষয়ক যুক্তি, ব্যাখ্যা এবং সূক্ষ্ম অথচ তির্যক উপমায় উপস্থাপিত। লালনে। লালনের প্রধান পরিচয় মূলত গানে। এই গানগুলি তাঁকে দুই শতাব্দী ধরে কালজয়ী করে রেখেছে। মধ্যযুগের ধর্মীয় সীমাবদ্ধতার বাইরে লালন মুক্তির পথ খোঁজার চেষ্টা করেছেন। তাঁর কণ্ঠে সুরারোপিত হয়ে তৈরি হয়েছে মানবধর্মের শ্রেষ্ঠ জয়গান। তিনি ছিলেন মানবপ্রেমের মূর্ত প্রতীক । লালন বিশ্বাস করতেন, সৃষ্টির মাঝেই স্রষ্টা বিরাজমান। স্রষ্টা ছাড়া মানুষও পরিপূর্ণ নয়। তাই সৃষ্টি আর স্রষ্টা একে অপরের প্রতিরূপ । লালন মনে করেন, এই মানবদেহ স্রষ্টার বাসস্থান। দেহস্থিত পরমাত্মা বা আত্মাকে লালন-সংগীতে ‘মনের মানুষ' নামে অভিহিত করা হয়েছে। আত্মদর্শনকারী লালন পরমসত্তার চিরজাগ্রত রূপকে মানবগুরুর ভিতরেই খুঁজতে বলেছেন। কারণ স্রষ্টা চিরজাগ্রত মানবগুরুর ভিতরেই বাস করে জগৎজুড়ে লীলা-রহস্যের খেলায় মত্ত হয়ে আছেন। আর সেই মানুষ লালনের ভাষায় ‘সহজ মানুষ', ‘মনের মানুষ’, ‘আলেকের মানুষ’, ‘অচিনপাখি'। লালন তাকেই ভজতে বলেছেন। তিনি মানুষের ভিতরে লুকিয়ে থাকা সেই পরমাত্মারূপে বিরাজমান মনের মানুষকেই সতত সন্ধান করেছেন এবং সাধন ভজনের জন্য গুরুতত্ত্বে একমাত্র মানুষের মুক্তির কথা বলেছেন। মানুষ হয়ে মানুষের কাছে প্রেম নিবেদন, ভালোবাসা চাওয়া ও মানুষকে ভজাটাই আসল সাধন-ভজন; আর এর মধ্য দিয়েই পরমাত্মার সন্ধান পাওয়া যাবে।

বহুকাল আগে চণ্ডীদাস বলেছিলেন, “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।” গ্রিক চিন্তাবিদ প্রোটাগোরাসের মতে, মানুষই সব কিছুর পরিমাপক। মানুষই সব কিছু নির্ধারণ করে। লালন বললেন, মানুষ ভজার মধ্য দিয়েই প্রকৃত সিদ্ধিলাভ ও আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন হয় । তবে সত্যের পথে তাঁকে সাধন-ভজন করতে হবে, নইলে মুল হারিয়ে অমূলের আঁধারে নিমজ্জিত হতে হবে। অকুলে আর পথ পাওয়া যাবে না। লালনের সেই ‘সোনার মানুষ’ উজ্জ্বল হয়ে লুকিয়ে রয়েছে দুই পাপড়ির পদ্মে। মানুষ-গুরুর কৃপা হলে সেই মনের মানুষের স্বরূপ উপলব্ধি করা যাবে। ফকির লালন গুরুবাদী ধর্মে সাধন-ভজনের মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে থাকা পরম মনুষ্যত্ববোধকে জাগ্রত করতে চেয়েছেন। মনুষ্যত্ববোধই মানবতা সৃষ্টির আধার, মানবিকতাবোধ জাগরণের উন্মুক্ত সহায়ক। তাই লালন যখন বলেন, “এই মানুষে মানুষ গাথা” তখন মনুষ্যত্ববোধের সমুজ্জ্বল ছবি স্পষ্ট হয়। তাঁর মতে, মানবতাই মানুষের মুক্তির পথ, মানুষের সাধনার চাবিকাঠি।

পরজীবী উদ্ভিদ আলেকলতার মতো মানুষকে অবলম্বন করেই মানুষের স্বরূপ উপলব্ধি করতে হবে। প্রথাগত কুসংস্কার ও জাতপাত-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে লালন প্রতিবাদ জানিয়েছেন তাঁর গানে। মানুষ ভজনার মধ্যেই রয়েছে ফকির সাধনার মূলবস্তু। ফকির লালন তাই সামাজিক বৈষম্য ভুলে প্রেম, ভালোবাসা, সাম্যের এক আকাশের নীচে মানুষকে রাখতে চেয়েছেন। এই মানুষের বিহনে মন শূন্যতার বোধ উপলব্ধি করে। এই তিক্ত শূন্যতা মানুষের সহ্যের অতীত। লালন তাই বলেন, “মানুষ ছাড়া মন আমার / পড়বি রে তুই শূন্যকার”। লালনের গানের মধ্যে এমন এক ধরনের অমিয় জাদু আছে যা রূপ-রস-ছন্দ নিয়ে আমাদের হৃদয় হরণ করে, আমাদের প্রচলিত মানবসমাজে শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ভাবুক, চিন্তাশীল, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে একটা মানবিক চিন্তা-চেতনা ও মানুষ ভজার জগতে নিয়ে যায়। তাঁর গানে সাম্য, শান্তি ও মানবমুক্তির সন্ধান মেলে। লালনের কথায় “মানুষ আকার, / ভজলে তরবি।”

❐ লালন শাহ ফকিরের গান কবিতার উৎস : লালনের গান দুই বাংলায় সমানভাবে জনপ্রিয়। তাঁর গান মূলত আত্মভোলা মানুষের মুখে মুখে ঘুরত। বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও লালন-বিশেষজ্ঞ ড. আবুল আহসান চৌধুরী লালনের অসংখ্য গান নিয়ে ‘লালন সমগ্র' নামক নির্ভরযোগ্য ও প্রামাণ্য একটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেন। ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি' গানটি আহসান চৌধুরীর 'লালন সমগ্র' গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। এ ছাড়া ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত ড. মতিলাল দাশ ও পীযূষকান্তি মহাপাত্র সম্পাদিত 'লালন-গীতিকা' গ্রন্থের ৩৯১ সংখ্যক গান হিসেবে এটি গৃহীত হয়েছে। উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ উক্ত গানটিকে “লালন শাহ্ ফকিরের গান' নামে পাঠ্য কবিতা হিসেবে সংকলিত করেছে।

 আরো পড়ুন : 
একাদশ শ্রেণি বাংলা সেমিস্টার  II 
Class - XI Bengali (2nd Semester)
গল্প
ছুটি Click Here
তেলেনাপোতা আবিষ্কার Click Here
কবিতা
ভাব সম্মিলন Click Here
লালন শাহ্ ফকিরের গান Click Here
নুন Click Here
নাটক
আগুন Click Here
পূর্ণাঙ্গ সহায়ক গ্রন্থ : পঞ্চতন্ত্র
বই কেনা Click Here
আজব শহর কলকেতা Click Here
পঁচিশে বৈশাখ Click Here
আড্ডা Click Here


বাংলা শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাস | তৃতীয় অধ্যায় : আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ধারা-গদ্যসাহিত্য | কাব্য কবিতার ধারা | বাংলা নাটক ও যাত্রার ধারা |  উপন্যাস ও ছোটোগল্প | চতুর্থ অধ্যায় : লৌকিক সাহিত্যের নানা দিক | প্রবন্ধরচনা |মানস-মানচিত্র অনুসরণে -বিতর্কমূলক

বাংলা শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাস
তৃতীয় অধ্যায় : আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ধারা
গদ্যসাহিত্য Click Here
কাব্য কবিতার ধারা Click Here
বাংলা নাটক ও যাত্রার ধারা Click Here
উপন্যাস ও ছোটোগল্প Click Here
চতুর্থ অধ্যায় : লৌকিক সাহিত্যের নানা দিক Click Here
প্রবন্ধরচনা
Click Here



 ❐ কবিতা লালন শাহ্ ফকিরের গান
মার্ক - ২  পরীক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সাজেশন নোটস 

১. লালন কোন মানুষকে ‘সোনার মানুষ' বলেছেন?
➛ সোনা উজ্জ্বল ও মূল্যবান ধাতু-বিশেষ। শরীরে ধারণ করলে ঔজ্জ্বল্য বাড়ে। দুই পাপড়ির পদ্মে সোনার মতো আলোকিত করে থাকা মানুষকেই লালন ‘সোনার মানুষ' বলেছেন। লালন বলেন, এই ‘সোনার মানুষ’-কে লাভ করা অত্যন্ত কঠিন, তবুও মানুষ ভজন করার মতো দুঃসাধ্য ও জটিল কাজটি যাঁরা করে থাকেন ও মনের মানুষের সন্ধান পান, লালনের কাছে তাঁরাই ‘সোনার মানুষ'।

২. “মানুষ-গুরু কৃপা হ’লে/জানতে পাবি। - সরলার্থ করো।
➛ লালন বলেন মানবদেহের ভিতর 'অচিনপাখি' তথা মনের মানুষের বাস। গুরু কৃপায় তাঁকে পাওয়া যায় কিন্তু তাঁকে লাভ করা এত সহজ নয়। জ্ঞানসাধনা, যোগসাধনা ও বামাচারের কষ্টসাধ্য কাঁটা বিছানো পথ অতিক্রম করে তবেই পদ্মাসনে আসীন সেই মানুষরতনকে পাওয়া যাবে। কিন্তু তারজন্য দরকার মনের মানুষের সায়। ‘মানুষ-গুরু কৃপা করলে সেই দুর্লভ ধনকে পাওয়া যায়।

৩. বাউল মতে নিজেকে চেনার উপায় কী?
➛ বাউল তত্ত্ব ও বাউল সাধনার মূল কেন্দ্রবিন্দু হল মানবদেহ। বাউল সাধকেরা মনে করেন, গুরুবাদী দর্শনের দ্বারা মানবদেহকে বশে আনতে পারলে, খণ্ড থেকে অখণ্ডের পথে যাত্রা করলে, রূপসাধনে সাঁতার দিতে পারলে, নিরিখ বেঁধে সাধন করতে পারলে তবেই একান্তে নিজেকে চেনা যায়। লালনের সাধন-ভজনের মূল মন্ত্রই ছিল নিজেকে চেনো বা জানো অর্থাৎ ‘আত্মংবিদ্ধিং’।

৪. লালনের দর্শন বর্তমানে কতটা প্রাসঙ্গিক?
➛ লালনের পুণ্যবাণী ছিল, সত্য পথে চলো, সত্য কথা বলো, মানুষকে ভালোবাসো। মানুষকে ভজলেই ‘সোনার মানুষ' হওয়া সম্ভব। সমাজে প্রতিনিয়ত ঘটে চলা নানা অন্যায়, অত্যাচার, ব্যাভিচার, হিংসা-বিদ্বেষ প্রভৃতি বন্ধ করতে হলে লালনের দেখানো পথই আমাদের একমাত্র অবলম্বন হওয়া উচিত। লালন-দর্শন মানুষকে সুপথে চলার পরামর্শ দেয়। লালনের দেখানো পথই প্রকৃত আলোর পথ। তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষকে শান্তির পথে চলার আহ্বান জানিয়েছেন।

৫.'মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি'-কার লেখা কোন মূল গ্রন্থের অন্তর্গত গানটি?
➛ 'মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি' গানটির রচয়িতা মহাসাধক সত্যসন্ধানী মরমি কবি লালন শাহ্। লালনের গানগুলি মূলত সংখ্যাদ্বারা চিহ্নিত। তাঁর বিক্ষিপ্ত গানগুলিকে একত্রিত করে বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ড. আবুল আহসান চৌধুরী 'লালন সমগ্র' নামে একটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেন। 'মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি' গানটি 'লালন সমগ্র' গ্রন্থে পাওয়া যায়। এ ছাড়া ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত ড. মতিলাল দাশ ও পীযূষকান্তি মহাপাত্র সম্পাদিত 'লালন-গীতিকা' গ্রন্থে ৩৯১ সংখ্যক গান হিসেবে এটি গৃহীত হয়েছে। উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ উক্ত গানটিকে 'লালন শাহ্ ফকিরের গান' নামে পাঠ্য কবিতা হিসেবে সংকলিত করেছেন।

৬. লালন ফকিদের পরিচয়সহ তাঁর জন্মস্থান ও জন্মকাল লেখো। 
➛ বাউল সম্রাট মহাসাধক সত্যসন্ধানী পরমপুরুষ লালন শাহ্ ছিলেন মানবপ্রেমের মূর্ত প্রতীক। তাঁর জন্মস্থান ও জন্মকাল নিয়ে বহু মতান্তর আছে। তবে অধিকাংশ গবেষক মনে করেন, তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশের) কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের ভাঁড়ারা গ্রামে লালন ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দের ১৭ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন এবং তাঁর মৃত্যু হয় ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ অক্টোবর।

৭. 'মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি'—'সোনার মানুষ' কীভাবে হওয়া যায়?
➛ পরম সাধক বাউল তাত্ত্বিক লালন শাহ্ ফকির মনে করতেন, যিনিই পরমাত্মা তিনিই ঈশ্বর । মানবের মাঝেই ঈশ্বর বিরাজমান। মানুষই হলেন ভক্তি ও পরম গুরুজ্ঞানের আধার। মানুষ ভজার মধ্য দিয়ে সিদ্ধিলাভ ও পরমাত্মার সঙ্গে মিলন হয়। জগতে মানুষকে ভজলে, মানুষকে নমস্য জানালে ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্য হয়ে ‘সোনার মানুষ' হওয়া যায়।

৮. ‘মানুষ ছেড়ে ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি।।’—‘মানুষ ছেড়ে' বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
➛ বাউল তত্ত্ব দর্শনে মানুষই মুখ্য। আবার মানুষের মধ্যেই পরম ঈশ্বরের অবস্থান। আমাদের পাঠ্যাংশ 'লালন শাহ্ ফকিরের গান' কবিতায় মানবতাবাদী দার্শনিক কবি লালন ফকির তাই মানুষকে ভালোবাসতে বলেছেন। মানুষকে ভালোবাসলেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুধাবন করা সম্ভব। মানবিক মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্বের জাগরণ ঘটিয়ে স্রষ্টার প্রতি অর্ঘ্য নিবেদন করতে হয়। স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির মধ্যেই বিরাজমান। তাই মানুষকে ছাড়লে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়।

৯. লালনের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে কী জান?
➛ লালন আত্মদর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। লালন-দর্শনে মূলত মানুষ ও মানবতাবাদ মুখ্য। লালন অধার্মিক ছিলেন না। ধর্মকে তিনি সম্মান করতেন। কিন্তু ধর্মের গোঁড়ামি মানতেন না। কোনো বিশেষ ধর্মের রীতিনীতি পালনে তিনি আগ্রহী ছিলেন না। সব ধর্মের বন্ধন ছিন্ন করে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন জীবনে। তিনি মনে করতেন মানুষের মাঝেই ঈশ্বরের অবস্থান। তাই মানুষকে ভালোবাসার কথা বারবার বলেছেন তাঁর গানে।

১০. লালন তাঁর গানে কী বার্তা দিতে চেয়েছেন?
➛ জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে উঠে লালন মানবতার বার্তা দিয়েছেন তাঁর গানে। তিনি মনে করতেন, মানবধর্মই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। মানবতাই মানুষের মুক্তির পথ, মানুষের মানুষ হওয়ার সাধনার চাবিকাঠি। লালনের আত্মদর্শন হল দেহ-মন, আত্মা-পরমাত্মা, প, আকার, সাকার প্রভৃতি। তাই স্রষ্টাকে লাভ করতে গেলে মানুষকে ভালোবাসতে হবে।

১১. জীবনদর্শন সম্পর্কে বাউলের মত কী?
➛ বাউল সাধকের মূল প্রতিপাদ্য মানবদেহ। বাউলরা সবচেয়ে গুরুত্ব দেয় আত্মাকে। তাঁদের মতে, আত্মাকে জানলেই পরমাত্মা বা সৃষ্টিকর্তার সন্ধান পাওয়া যায়। আত্মার বাস যেহেতু মানবদেহে, তাই দেহকে তাঁরা পবিত্র জ্ঞান করেন। দেহের মাঝেই তাঁরা খোঁজেন 'অচিনপাখি'-র ঠিকানা। সাধারণত স্বল্প শিক্ষিত হলেও বাউলরা জীবনদর্শন সম্পর্কে গভীর জ্ঞান ও তত্ত্বকথা বলেছেন তাঁদের গানে। তাদের দর্শন ও মতামত বাউল গানের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে।

 ❐ কবিতা লালন শাহ্ ফকিরের গান
মার্ক - ৩ পরীক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সাজেশন নোটস 

১. বাউল কারা এবং বাউল সংগীতের পরিৎ-ই বা কে?
➛ বাউল হল বিশেষ একটি লোকাচার ও ধর্মমত। প্রচলিত ধর্মীয় সংকীর্ণতা ও সংস্কার থেকে মুক্ত সম্প্রদায়বিশেষকে বাউল নামে চিহ্নিত করা হয়। বাউল সংগীত মূলত মানুষের জীবনদর্শনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। বাউলরা সাদামাটা জীবনযাপন করেন এবং একতারা বাজিয়ে গান গেয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানোই তাঁদের অভ্যাস। উদার ও অসাম্প্রদায়িক এই ধর্মসাধকেরা মানবতার বাণী প্রচার করেন। লালন শাহ্ ছিলেন বাংলার বাউল সংগীতের অগ্রদূত। বাউল সংগীত সতেরো শতকে জন্ম নিলেও লালনের গানের জন্য ঊনিশ শতকে বাউল গান জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

২. লালন তাঁর গানে কাকে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং কেন?
➛ লালন তাঁর চিন্তা-চেতনায়, ভাবে-ভাবনায় ও বিশ্বাসে মূলত মানুষকেই প্রাধান্য দিয়েছেন, মানুষের জয়গান গেয়েছেন। তিনি ছিলেন মনবতার পূজারি। লালন-দর্শনে মানুষ ও মানবতাবাদই মুখ্য হয়ে উঠেছে। আধ্যাত্মিক কবি লালন গুরুবাদী দর্শনে বিশ্বাসী। তিনি মনে করতেন মানুষের অন্তরেই পরমাত্মার অধিষ্ঠান। তাই মানুষকে ভালোবাসতে পারলে, মনুষ্যত্বের জাগরণ ঘটিয়ে মানবিকতায় উন্নীত হতে পারলে 'মনের মানুষ'
অর্থাৎ পরমাত্মার সন্ধান লাভ করা যায়। সাধন-ভজনের মাধ্যমে গুরুতত্ত্ব আশ্রয় করে মানুষকে ভজলে ঈশ্বর লাভ সম্ভব।

৩. 'মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি'—কোন কবিতায় কবি কেন মানুষ ভজতে বলেছেন?
➛ বাউল সাধক লালন শাহ্ রচিত উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ নির্ধারিত পাঠ্য কবিতা 'লালন শাহ্ ফকিরের গান' কবিতা থেকে আলোচ্য অংশটি নেওয়া হয়েছে। বাউলসাধনার মূল তত্ত্বই হল মানবসাধনা। বাউল মতে, সৃষ্টির মধ্যে স্রষ্টা নিহিত, মানবের মাঝেই বিরাজ করেন পরমাত্মা। তাই মানুষকে ভালোবাসলে ঈশ্বরের উপাসনা হয়, মানুষকে ভজনা করলে স্রষ্টাকেই ভজন করা হয়। কবি তাই মনুষ্যত্ববোধে উদ্দীপ্ত হয়ে মানবিকবোধের জাগরণ ঘটিয়ে মানুষকে ভালোবাসতে বলেছেন।

৪. ‘মানুষ ছেড়ে ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি।—অর্থ পরিস্ফুট করো।
➛ বাউল সাধকরা ভবসংসারে ঘরছাড়া, পরমাত্মার সন্ধানে অবিরাম রত। কবি ‘ক্ষ্যাপা’বলতে বাউলসাধনায় রত বাউল সাধকের বাউল মনকে বুঝিয়েছেন। লালন ফকির মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন, পৃথিবীর মানব সন্তানের মধ্যে অধরা মনের মানুষের বাস। নিরিখ বেঁধে সত্য মনে তাঁকে সাধনা করতে পারলে তবেই প্রকৃত সিদ্ধিলাভ ও পরমাত্মার সঙ্গে মিলন হতে পারে। নইলে মূল হারাতে হবে, সাধের মানব জনম একেবারে বিফলে যাবে, অমূলের অন্ধকারে দিবানিশি হাবুডুবু খেতে হবে। অকূলে আর কূল পাওয়া যাবে না।

৫. 'দ্বি-দলের মৃণালে / সোনার মানুষ উজ্জ্বলে—উক্তিটির প্রসঙ্গ নির্দেশ করে অর্থ লেখো।
➛ বাউলসম্রাট লালন ফকির মনে করতেন, মানবদেহের ভিতর পরমাত্মার বসতি। সবাই টের পেলেও সেই পরমাত্মাকে কেউ স্পর্শ করতে পারে না কিংবা মানবচক্ষে দেখতে পায় না। মনের মানুষের অবস্থান প্রসঙ্গে কবি  উক্তিটির অবতারণা করেছেন।

বাউলগণ দেহতত্ত্ববাদী। ফকিরের মতে, মানবদেহের ভিতরে আছে আঠারো মোকাম (অর্থাৎ আঠারোটি ঘর), ছয় লতিফা (ষড়চক্র), বারো বরজ, চারচন্দ্র (মল, মূত্র, শুক্র, রজ), চৌদ্দো ভুবন, যড়রিপু ও দশ ইন্দ্রিয়ের মতো দ্বি-দল মৃণাল অর্থাৎ দুই পাপড়ির পদ্ম। দেহের মধ্যে সেই দ্বি-দল পদ্মেই আলোকিত হয়ে আসীন রয়েছেন সোনার মানুষ। সূর্যকিরণবিম্বিত অথই রূপসাগরে ডুব দিয়ে সাধন-ভজনের দ্বারা তাকে লাভ করতে হবে। কবি সেই সোনার মানুষের কথা এখানে বলেছেন।

৬. 'এই মানুষে মানুষ গাথা' — মানুষে কীভাবে মানুষ গাথা আছে?
➛ মরমি কবি লালন শাহ্ রচিত উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ নির্ধারিত পাঠ্য কবিতা 'লালন শাহ্ ফকিরের গান' কবিতা থেকে আলোচ্য অংশটি নেওয়া হয়েছে। মানুষের স্বরূপ উপলব্ধিই বাউলজীবনের একমাত্র লক্ষ্য। লালন ফকির আজীবন ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-জাতহীন এক মানবিক সমাজের স্বপ্ন দেখেছেন, যে সমাজে মানুষই সব, মানুষের মানবিক মূল্যবোধই সমাজের সহায়ক। মানুষের প্রকৃত পরিচয় মানবিক মূল্যবোধে বা মনুষ্যত্বে। এই মনুষ্যত্ববোধ থেকেই উদ্ভূত হয় মানবিকতাবোধ। মানবতাই প্রকৃতপক্ষে মুক্তির পথ, মানুষ হওয়ার সাধনার চাবিকাঠি। লালন গুরুবাদী ধর্মে সাধন-ভজনে মানুষের সেই মনুষ্যত্ববোধকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। মানুষকেই ভালোবাসলে ঈশ্বরের সন্ধান মেলে। মানুষের ভিতরেই তো ঈশ্বর বিরাজমান। তাই মানুষের সঙ্গে মানুষের ভালোবাসার সম্পর্ক গভীর ও দৃঢ় হওয়া প্রয়োজন।

৭. 'জেনে শুনে মুড়াও মাথা/জাতে তরবি।'—উক্তিটির অর্থ নিরূপণ করো।
➛ উদ্ধৃতাংশটি লালন শাহ্ রচিত 'লালন শাহ্ ফকিরের গান' কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে। লালন তাঁর গানে জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে উঠে এই সমাজে মানবিক বার্তা দিয়েছেন। প্রচলিত ধারণা ও নানা সংস্কারে আচ্ছন্ন সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষে সন্ন্যাস গ্রহণের পূর্বে মস্তক মুণ্ডন বা মাথা মুড়ানোর রেওয়াজ প্রচলিত। ঈশ্বরের স্বরূপ উপলব্ধির জন্য এই চূড়ান্ত বাস্তবতার পথ অবলম্বন করতে হয়। সেই ‘চূড়ান্ত বাস্তবতা’-র স্বরূপ হল লালনের ‘মনের মানুষ’–যিনি দেহখাঁচার মধ্যে অচিনপাখি বা আত্মারূপে বিরাজমান। ‘অচিনপাখি'-রূপী সাঁই সর্বদা সেখানে লীলায় মগ্ন । তাঁকে জানার মাধ্যমেই জাতে উঠে এক মহিমান্বিত আধ্যাত্মিক স্তরে পৌঁছোনো যায়। আসলে যে মানুষ নিজেকে চিনেছে, সে ঈশ্বরকেও চিনেছে।

৮. ‘মানুষ ছাড়া মন আমার/পড়বি রে তুই শূন্যকার—এই ‘মানুষ'-এর পরিচয় দিয়ে ‘মানুষ ছাড়া মন’ শূন্য কেন বুঝিয়ে দাও।
➛ লালন ফকির তাঁর গানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক মনোভাব পোষণ করেছেন। মানুষের ভিতরেই তিনি সন্ধান করেছেন ‘অরূপ রতন'। আলোচ্য উদ্ধৃতাংশে ‘মানুষ' বলতে সেই অরূপ রতন স্বরূপ 'মনের মানুষ'-কে বোঝানো হয়েছে। 

বাউল সাধকেরা বিশ্বাস করেন, মানুষ প্রতি মুহূর্তে যে শূন্যতার বোধ উপলব্ধি করে তা আসলে ‘মনের মানুষ'-এর বিহনে। মনের মানুষকে উপলব্ধি করতে না পারলে সবই শূন্য মনে হয়। অন্তর যেন হাহাকার করে, সবই অসার আর নিরর্থক মনে হয়। এই শূন্যতা মানুষের সহ্যের অতীত। তাই সেই নিরালম্ব শূন্যতা ভরিয়ে তুলতেই মানুষ ভজনে ব্রতী হয়। সেই মানুষের অলীক স্পর্শ লাভ হলে তবেই পরম আনন্দ আর গভীর চিত্তসুখ লাভ হয়। তাই কবির মতে, ‘মানুষ ছাড়া মন’ শূন্যকার। 

একাদশ দ্বিতীয় সেমিস্টার বাংলা লালন শাহ ফকিরের গান,লালন শাহ ফকিরের গান একাদশ শ্রেণী বাংলা কবিতা,লালন ফকিরের গান,লালন ফকিরের বাউল গান,লালন শাহ ফকিরের গান কবিতা class 11,একাদশ শ্রেণি লালন শাহ ফকিরের গান

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)