Class 11 Bengali 2nd Semester : Chapter 1 Chuti Question Answer
❐ ছুটি গল্পের বিষয়বস্তু : ফটিক গ্রামের দুরন্ত বালক। তেরো-চোদ্দো বছর বয়সের ফটিক সমবয়সি বালকদের সর্দার। খেলার সময় প্রতি মুহূর্তে তার মাথায় নতুন নতুন চিন্তার উদয় হয়। সেদিন বিকালে সেরকমই এক উদ্ভাবনী চিন্তা আসে ফটিকের মাথায়—নদীর ধারে পড়ে থাকা একটি শালকাঠের গুঁড়িকে তাদের খেলার সরঞ্জাম হিসেবে গড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। বালকেরা যখন গুঁড়িটি ঠেলার জন্য প্রস্তুত তখন বিঘ্ন ঘটায় ফটিকের ভাই মাখনলাল। অতর্কিতে সে গম্ভীরভাবে সেই গুঁড়ির ওপর গিয়ে বসে পড়ে। অন্য বালকেরা নামতে বললেও সে নামে না। ফটিক সর্দারি মনোভাব নিয়ে ভয় দেখায়, তবুও মাখন দার্শনিকের মতো চুপ করে বসে থাকে। মাথায় আবার নতুন চিন্তার উদয় হয়—মাখন সমেত গুঁড়িটিকে ঠেলা হবে। বালকেরা ভাবল বেশ মজা হবে। মাখন ভাবল, এতে তার গৌরব বৃদ্ধি হবে। কিন্তু খেলার ফল হয় মারাত্মক। গুঁড়ি একপাক ঘুরতে-না-ঘুরতেই মাখন তার গাম্ভীর্য সমেত মাটিতে পড়ে যায়।
রাগ গিয়ে পড়ে দাদার ওপর। ফটিককে অন্ধভাবে মারতে থাকে মাখন। তার নাকে মুখে আঁচড় কেটে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। অচিরেই খেলা ভঙ্গ হয়। আনমনা ফটিক নদীর ধারে নৌকার ওপর বসে কাশের গোড়া চিবোতে থাকে। সেইসময় ঘাটে আসে একটি বিদেশি নৌকা। অর্ধবয়সি এক ভদ্রলোক নৌকা থেকে নেমে চক্রবর্তীদের বাড়ি যাওয়ার ঠিকানা জানতে চাইলে ফটিক সদুত্তর দেয় না। ফটিকের মন ভালো নেই, সে একাকী থাকতে চায়। কিন্তু কিছুক্ষণ পর বাঘা বাগদির সক্রিয় চেষ্টায় ফটিককে বাড়ি ফিরতে হয়। মায়ের সামনে মাখন মিথ্যা বলে ফটিককে অপরাধী প্রমাণ করতে চাইলে ফটিক মাখনের গালে সবেগে এক চড় কষায়। মা মাখনের পক্ষ নিলে অভিমানী ফটিক মাকে ঠেলে দেয়। ঠিক সেই মুহূর্তে সেই বিদেশি বাবু তাদের বাড়িতে আসেন। তাঁকে দেখেই ফটিকের মা বিস্ময়ে আনন্দে দাদা বলে প্রণাম করে। আসলে সেই বিদেশি ভদ্রলোক হলেন ফটিকের মামা বিশ্বম্ভরবাবু।
বহুদিন তিনি পশ্চিমে কর্মে নিযুক্ত ছিলেন। বাড়ি ফিরে বোন-ভাগ্নেদের দেখতে এসেছেন। ফটিকের মায়ের বিয়ের পরে তিনি একবারও আসেননি। ইতিমধ্যে ফটিক ও মাখনের জন্ম হয়েছে, তাদের বাবাও মারা গেছে, তারা ক্রমশ বড়ো হয়ে উঠেছে। দাদার না-আসা নিয়ে ফটিকের মায়ের কিছু অভিমানও আছে। মামার সস্নেহ আদরে কিছুদিন তাদের বেশ সমারোহে কাটে। বিশ্বশুরবাবু ছেলেদের পড়াশোনা ও মানসিক উন্নতির খোঁজ নেওয়ার সময় জানতে পারেন ফটিক অবাধ্য, উচ্ছৃঙ্খল ও পাঠে অমনোযোগী এবং মাগন সুশীল, শান্ত ও বিদ্যানুরাগী। তাই ফটিককে তিনি কলকাতায় নিয়ে গিয়ে নিজের কাছে রেখে পড়াশোনা করানোর প্রস্তাব দেন। এ প্রস্তাবে ফটিক ও তার মা সহজেই রাজি হয়ে যায়। ফটিক কলকাতায় যাওয়ার সময় তার সমস্ত খেলার সরগ্রাম উত্তরাধিকারী হিসেবে মাখনকে দিয়ে যায়।
বালকদের সর্দার ফটিক কলকাতায় এলে তার মামার বাড়িতে যথাযথ সমাদর পায় না। মামা ছাড়া কেউ তাকে ভালোবাসে না। মামার তিনটি সন্তান। মামীর অনাদর, উপেক্ষা, অবিচার ফটিককে আঘাত দেয়। গ্রামের মুক্ত পরিবেশে অভ্যস্ত ফটিক শহরের যান্ত্রিক বদ্ধ পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারে না, হাঁপিয়ে ওঠে। তার দুরন্তপনা শহরের বদ্ধতায় শান্ত হয়ে যায়। বনের উন্মুক্ত পাখি যেন খাঁচায় বন্দি হয়ে থাকে। ফটিক মুক্তি চায়, সে বাড়ি ফিরতে চায়। কিন্তু পুজোর ছুটি না হওয়া অবধি তাকে অপেক্ষা করতে হয়। কার্তিক মাসে পুজোর ছুটিতে মামা তাকে বাড়ি নিয়ে যাবে। কিন্তু শহর কলকাতা ফটিকের মানসলোকে এতই বিরূপ হয়ে ওঠে যে ফটিক পুজোর ছুটি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চায় না। শ্রাবণের অবিশ্রান্ত ধারায় জ্বর গায়ে একদিন কাউকে কিছু না-জানিয়ে সে পালিয়ে যায়।
প্রবল বৃষ্টির মধ্যে পুলিশের গাড়ি আবার তাকে পৌঁছে দেয় মামার বাড়ি। জ্বর ক্রমশ বেড়েই চলে। প্রবল জ্বরে প্রলাপ বকতে থাকে ফটিক। মামা অস্থির হয়ে চিকিৎসক ডাকেন, ফটিকের মাকে খবর দেন। কিন্তু পরিস্থিতি ভালো না-ঠেকায় রুমালে চোখ মোছেন। ফটিকের মা গ্রাম থেকে এসে ঝড়ের বেগে ঘরে প্রবেশ করে। মাকে দেখে ফটিক চলে যে তার ছুটি হয়েছে, সে বাড়ি যাচ্ছে। খালাসিদের মতো সুর করে প্রলাপ বকে চলে ফটিক। ফটিক 'ছুটি' চায়, জীবনের অন্তহীন সমুদ্রে তলিয়ে যেতে চায়। তাই পৃথিবী থেকে সে চিরদিনের মতো ছুটি নেয়। তার এই ‘ছুটি' গল্পে গভীর ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে।
❐ উৎস : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'ছুটি' গল্পটি রচনা করেন ১২৯৯ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসে। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় 'সাধনা' পত্রিকায় ১২৯৯, পৌষ (১৮৯২, ডিসেম্বর) সংখ্যায়। বর্তমানে 'ছুটি' গল্পটি গল্পগুচ্ছের প্রথম খণ্ডে সংকলিত। 'ছিন্নপত্রাবলী'-র ২৪ সংখ্যক পত্রে রবীন্দ্রনাথ সাজাদপুর থেকে ইন্দিরা দেবীকে লিখেছিলেন—“ডাঙার উপর একটা মস্ত নৌকোর মাস্তুল পড়েছিল। গোটাকতক বিবস্ত্র ক্ষুদে ছেলে মিলে অনেক বিবেচনার পর ঠাওরালে যে, যদি যথোচিত কলরব-সহকারে সেইটেকে ঠেলে ঠেলে গড়ানো যেতে পারে তা হলে খুব একটা নতুন এবং আমোদজনক খেলার সৃষ্টি হয়।” এই সামান্য দৃশ্যপটেই অসামান্য 'ছুটি' গল্পের সৃষ্টি।
একাদশ শ্রেণি বাংলা দ্বিতীয় সেমিস্টার | একাদশ শ্রেণির বাংলা গল্প - ছুটি মার্ক : ৫ নোটস | একাদশ শ্রেণী ছুটি গল্পের বড়ো প্রশ্ন উত্তর
১. ‘ছুটি' গল্পের নামকরণ কতখানি সার্থক তা আলোচনা করো। (মার্ক - ৫)
❐ নামকরণের তাৎপর্য : সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল নামকরণ। কাহিনিপাঠের পূর্বেই কাহিনির অন্তর্নিহিত মর্মবস্তুটি পাঠকের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে নামকরণের মাধ্যমেই। নামকরণ চরিত্রপ্রধান, বিষয়কেন্দ্রিক, ব্যঞ্জনাধর্মী – নানা প্রকারের হতে পারে। এখন আমাদের আলোচনা করে দেখতে হবে 'ছুটি' গল্পের নামকরণটি কোন্ প্রকৃতির এবং কতখানি সার্থক হয়েছে। সজীব গ্রাম্য প্রকৃতির কোলে একটু একটু করে বেড়ে উঠতে থাকা প্রাণবন্ত কিশোর ফটিকের অশ্রুমর্মর কাহিনি হল 'ছুটি' গল্পটি। নিত্যনতুন দুষ্ট বুদ্ধির উদ্ভাবনে ফটিক ছিল তার বাল্যবন্ধুদের মধ্যে সর্দার। পড়াশোনায় তার কোনো মনোযোগ ছিল না, এমনকি তার দুষ্টুমিতে তার মা-ও তার প্রতি যথেষ্ট বিরক্ত ছিলেন। উচ্ছৃঙ্খল অবাধ্য ছেলেকে নিয়ে মায়ের মনে সর্বদাই চিন্তা থাকত কোনোদিন হয়তো ফটিক তার ভাই মাখনের না-কোনো দুর্ঘটনা ঘটায়।
এমন সময় একদিন ফটিকের মামা বিশ্বম্ভরবাবু ভগিনীর বাড়িতে আসেন। ভগিনীর মুখে ফটিকের কথা শুনে তিনি ফটিকের পড়াশোনার দায়িত্ব নেন এবং তাকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। দাদার প্রস্তাবে ফটিকের মা শুধু নয়, ফটিকও আনন্দ পায়। ফটিক আনন্দ পায় এই ভেবে যে, মামার বাড়িতে গেলে মা ও ভাইয়ের লাঞ্ছনার হাত থেকে সে কিছুকালের জন্যও ছুটি পাবে। বলা বাহুল্য, যে স্নেহ-ভালোবাসা ১৩-১৪ বছরের ফটিক খুঁজেছিল, ভেবেছিল মামার বাড়িতে হয়তো সেই স্নেহ-ভালোবাসার সন্ধান সে পাবে, কিন্তু এখানেও সে আশাহত হয়েছে। ফটিকের বালকোচিত সরল ব্যবহার, তার চলাফেরা, কথাবার্তা—সব কিছুই তার মামীর চোখে বিরক্তির কারণ হত।
ফটিক মামীকে নানাভাবে খুশি করতে চাইলেও, ফটিকের কোনো কাজকেই মামী ভালোভাবে মেনে নিতে পারেনি। ক্রমে ফটিক অনুভব করে, সে মামীর সংসারে অনাহুত এবং বেমানান। কলকাতার স্কুলেও সে নির্বোধের মতো সঙ্গীহীন; এমনকি মামাতো ভাইরাও তার পরিচয় দিতে কুণ্ঠাবোধ করত, বিদ্রুপ করত তার নির্বুদ্ধিতা নিয়ে। ক্রমে ফটিক কলকাতার চার দেয়ালের মধ্যে হাঁপিয়ে ওঠে। গ্রামের মুক্ত পরিবেশের কথা, বন্ধুদের কথা, দিগন্তবিস্তৃত মাঠে ছুটোছুটির কথা, নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা, ঢাউস ঘুড়ি নিয়ে বোঁ-বোঁ করে দৌড়ে বেড়ানো তার মনে পড়ে—বন্দি জীবন থেকে সে ছুটি পাবার অপেক্ষা করতে থাকে।
এরূপ অবস্থায় একদিন ফটিক তার স্কুলের বই হারিয়ে ফেলে। সে-কথা ফটিক তার মামীকে জানালে সেখানেও তার কপালে জোটে গঞ্জনা। সেই রাতেই ফটিক জ্বরে পড়ে। সে বুঝতে পারে মামী জ্বরের কথা জানতে পারলে তাকে আরও যন্ত্রণা পেতে হবে। যন্ত্রণা থেকে ছুটি পেতে ফটিক গভীর রাতে বেরিয়ে পড়ে তার গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে তার মায়ের কাছে ফিরে যেতে। কিন্তু সে মায়ের কাছে যেতে পারেনি। পরের দিন সন্ধ্যায় প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত ফটিককে পুলিশ যখন তার মামার বাড়িতে পৌঁছে দেয় তখন তার সারা শরীর ভিজে, কর্দমাক্ত – থরথর করে কাঁপছে। জ্বর ক্রমে বাড়তে থাকে, জ্বরের ঘোরে সে বলে “মামা আমার ছুটি হয়েছে কি?” সে খালাসীদের মতো বলতে থাকে – “এক বাঁও মেলে না, দো বাঁও মেলে না।” ফটিকের জ্বরের কথা শুনে গ্রামের বাড়ি থেকে উদ্ভ্রান্তের মতো তার মা ছুটে আসে; তখন ফটিক তার শেষ কথাটি বলে – “মা এখন আমার ছুটি হয়েছে, মা এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।”
এখানেই 'ছুটি' শব্দটি গভীর ব্যঞ্জনাময় হয়ে উঠেছে। ইহলোকের সকল বন্ধন থকে ছুটি নিয়ে ফটিক চিরতরে চলে গেছে পরলোকে। এক যন্ত্রণাপূর্ণ স্নেহহীন বালকের জীবনে প্রকৃত মুক্তি এসেছে মৃত্যুর পথ ধরে। এই বিশ্বসংসারে কেউ ফটিককে বুঝতে চায়নি। প্রকৃতির একান্ত আপন তাই যেন শেষ মুহূর্তে প্রকৃতির কোলেই চির নিদ্রা নিয়েছে। গল্পের সমাপ্তিতে ফটিকের এই চিরবিদায় গল্পের নামকরণকে ব্যাঞ্জনাগর্ভ ও হৃদয়স্পর্শী করে তুলেছে। তাই ব্যাঞ্জনাধর্মী নামকরণ হিসেবে 'ছুটি' যথার্থ ও সার্থক হয়েছে।
_____________
Class 11 2nd Semester Bengali
২. 'ছুটি' গল্পে ফটিকের চরিত্র আলোচনা করো। (মার্ক - ৫)
❐ 'ছুটি' গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফটিক সমগ্র গল্পজুড়ে তার অবস্থান। গল্পটির সূচনা ও সমাপ্তি ফটিককে নিয়েই। গল্পে তার যে চরিত্রবৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে তা নিম্নে আলোচিত হল—
◉ বালকদের সর্দার : বালকদের সর্দার ফটিকের বয়স তেরো-চোদ্দো বছর। সমবয়সীদের সাথে প্রতিনিয়ত নদীর ধারে নিত্যনতুন দুষ্টুমি ও উদ্ভাবনী খেলায় সে সর্দারত্ব লাভ করেছে। তার সর্দারি মেনে অন্যান্য বালকেরা তাকে অনুসরণ করে, তার কথায় গুরুত্ব দেয়। পড়াশোনায় তার মনোযোগ ছিল না। প্রকৃতির উন্মুক্ত পরিবেশে সে খেলে বেড়াতে ভালোবাসে। লেখক ফটিক চরিত্রের উচ্ছ্বলতা, চঞ্চলতা, দুরন্তপনা ও উদ্ভাবনী শক্তির সর্দার হিসেবে ‘ছুটি' গল্পে তাকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন।
◉ আত্মসম্মানবোধ ও উদারতা : দুরন্ত হলেও ফটিকের মধ্যে আত্মসম্মানবোধ ছিল প্রবল। মায়ের সামনে ছোটোভাই মাখন যখন মিথ্যা বলে যে দাদা তাকে মেরেছে তখন সে সহ্য করতে না-পেরে সবেগে মাখনের গালে চড় কষিয়ে দেয়। আবার মামার বাড়ি যাওয়ার আনন্দে সরল মনে সেই মাখনকে তার ছিপ, ঘুড়ি, লাটাই-এর উত্তরাধিকারী করে দিয়ে যায়। ফটিক চরিত্রের মধ্যে এমন এক উদারতা ছিল যা তাকে উন্মুক্ত প্রকৃতির উপযুক্ত প্রতিনিধি করে তোলে।
◉ প্রাণচঞ্চলতা : ফটিকের দুরন্ত স্বভাবের মধ্যে এমন এক প্রাণচঞ্চলতা ছিল যা মুক্ত প্রকৃতির সঙ্গে মামানসই। গ্রাম্য জীবনের উচ্ছ্বলতা, দুরন্তপনা, নদীর ধার—এসবের সঙ্গে ফটিকের আত্মীয়তা। সমবয়সী বালকদের সাথে উৎফুল্ল মনে সে খেলে বেড়াত। এ-নৌকা ও-নৌকা করে বেড়ানো তার স্বভাব ছিল।
◉ নাগরিক জীবনের সীমাবদ্ধতা : মুক্ত পাখিকে খাঁচায় বন্দি করলে যেমন হয় গ্রাম থেকে শহরে এসে ফটিকেরও সেই অবস্থা হয়েছিল। চঞ্চল ফটিক কলকাতার নাগরিক জীবনের যান্ত্রিকতায় বদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। মামীর নিষ্ঠুর আচরণ, মামাতো ভাইদের নির্মম ব্যবহার ও মাস্টারমশাইদের অত্যাচার তাকে বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছিল। তাই শহর ছেড়ে পুনরায় গ্রামে যেতে চেয়েছে ফটিক।
◉ জীবন থেকে ছুটি : পুজোর ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার জন্য ফটিক অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। কিন্তু কার্তিক মাস আর আসে না, তার আগেই জীবন থেকে ছুটি হয়ে যায় ফটিকের। পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেয় ফটিক। এ গল্প যেন ফটিকের কৈশোর জীবনের মনস্তত্ত্বের গল্প। বিশ্বসংসারে ফটিককে কেউ বুঝতে চায়নি। প্রকৃতির সন্তান তাই যেন শেষ মুহূর্তে প্রকৃতির কোলে চিরনিদ্রায় নিদ্রিত হয়ে যায়। তার মৃত্যু গল্পে আলাদা এক ব্যঞ্জনা তৈরি করে।
_____________
৩. 'মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।'—উদ্ধৃত উক্তিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো। (মার্ক - ৫)
❐ উদ্বৃত্ত উল্কিটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ছুটি' গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র কিশোর ফটিকের। গ্রাম্য পরিবেশে বড়ো হয়ে ওঠা ফটিক কলকাতা শহরে এসে শান্তি পায়নি। মামীর নির্মম অত্যাচার, মামাতো ভাইদের অনাদর ও শিক্ষকমশাইদের কটূক্তি, ব্যঙ্গোক্তিতে তার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। মামা বিশ্বম্ভরবাবু বলেছিলেন, পূজার ছুটি হলে তাকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবেন। কিন্তু স্কুলের ছুটির জন্য অপেক্ষা না-করে সে একদিন শ্রাবণের বৃষ্টিধারায় একাই বেরিয়ে পড়ে। বৃষ্টিতে ভিজে ফটিক জ্বরে আক্রান্ত হয়। অসুস্থ ফটিককে পুলিশ পৌঁছে দেয় বিশ্বভরবাবুর বাড়িতে। দুজন পুলিশের লোক তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে বিশ্বম্ভরবাবুর কাছে উপস্থিত করে। তার সারা শরীর তখন ভেজা, সর্বাঙ্গে কাদা, চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে, জ্বরে থরথর করে কাঁপছে। বিশ্বম্ভরবাবু প্রায় কোলে করে তাকে ভিতরে নিয়ে যান। ফটিকের জ্বর ক্রমশ বাড়তে থাকে। প্রলাপ বকতে থাকে ফটিক। খালাসিদের মতো সুর করে নানা প্রলাপ বকে। কখনও বিড়বিড় করে বলে, 'মা, আমাকে মারিসনে মা। সত্যি বলছি, আমি কোনো দোষ করিনি।' বিশ্বম্ভরবাবু অবস্থা ভালো নয় বুঝে চিকিৎসক ডাকেন। তার মাকেও খবর দেন। প্রবল জ্বরে ফটিক হতবুদ্ধির মতো লাল চোখ উন্মীলিত করে আপন মনে বলে, 'মামা, আমার ছুটি হয়েছে কি।'
খবর পেয়ে ফটিকের মা ছুটে আসেন এবং উচ্চৈঃস্বরে শোকপ্রকাশ করতে থাকেন। বিশ্বম্ভরবাবু বোনের শোকোচ্ছ্বাস নিবৃত্ত করলে তিনি খাটের ওপর আছাড় খেয়ে ডাকলেন, 'ফটিক! সোনা! মানিক আমার।' ফটিকের ছুটির সময় হয়েছে। তাই সে কাউকে ভ্রুক্ষেপ না-করে ধীরে ধীরে পাশ ফিরে মৃদুস্বরে বলল, “মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।’ 'ছুটি' কথাটি এখানে গভীর তাৎপর্য বহন করে। এই ছুটি স্কুলের সাময়িক ছুটি নয়, বাড়ি ফেরার ছুটি নয়, পৃথিবীর পাঠশালা থেকে ছুটি, জীবন থেকে বিদায় নেওয়ার জন্য চিরকালের মতো ছুটি।
___________
৪. 'পূর্বাপেক্ষা আর-একটা ভালো খেলা মাথায় উদয় হইয়াছে, পূর্বের খেলাটি কী ছিল? এখনকার খেলাটিই-বা কী এবং তার পরিণতি কী হয়েছিল? (মার্ক ২+৩=৫)
❐ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত 'ছুটি' গল্প থেকে প্রশ্নোদ্ধৃত অংশটি নেওয়া হয়েছে। কিছু গ্রাম্য, দুরন্ত, অর্বাচীন বালকদের প্রাত্যহিক খেলা হিসেবে উদ্ধৃত পূর্বের খেলাটি ছিল ভারি অদ্ভূত। প্রতিনিয়ত তারা নিত্যনতুন খেলায় মেতে ওঠে। নদীর ধারে প্রকান্ড একটা শালকাঠের গুঁড়ি নৌকোর মান্ডুলে পরিণত হওয়ার অপেক্ষায় পড়েছিল। বালকদের সর্দার ফটিকের উদ্ভাবনী চিন্তায় সেই কাঠের গুঁড়িটিকে গড়িয়ে গড়িয়ে কিছুদূর নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা হয়। কাঠের মালিক সঠিক সময়ে সেটি না-পেয়ে বিরক্ত, বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হবে আর তার অসুবিধা দেখে বালকেরা মজা পাবে—এটিই খেলা।
গুঁড়িটিকে গড়াবার জন্য সবাই যখন পরম উৎসাহে উদ্যোগী হয়েছে ঠিক তখনই তত্ত্বজ্ঞানীর মতো গম্ভীর ও উদাসীনভাবে ফটিকের ভাই মাখন গিয়ে বসে পড়ল সেই কাঠের ওপর। খেলায় বিঘ্ন ঘটাল সে। অন্যান্য বালকেরা উঠতে বলল কিন্তু মাখন নড়ল না। ফটিক ভয় দেখাল তবু মাখন সরল না। তখন তারা ঠিক করল মাখন সমেত গুঁড়িটিকে ঠেলে গড়িয়ে নিয়ে যাবে। এটাই ছিল তাদের এখনকার খেলা। মাখন ভেবেছিল গুঁড়ি সমেত তাকে ঠেলে গড়িয়ে নিয়ে গেলে তাতে তার গৌরব বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু বালকের দল 'মারো ঠেলা হেঁইয়ো, সাবাস জোয়ান হেঁইয়ো' বলে যখনই ঠেলা দিল, গুঁড়ি একপাক ঘুরতে না ঘুরতে গম্ভীর প্রকৃতির মাখন গাম্ভীর্য সমেত মাটিতে পড়ে গেল।
___________
৫. 'কিন্তু অন্যান্য পার্থিব গৌরবের ন্যায় ইহার আনুষঙ্গিক যে বিপদের সম্ভাবনাও আছে, তাহা তাহার কিম্বা আর কাহারও মনে উদয় হয় নাই।— রচনার নামোল্লেখ সহ উদ্ধৃতাংশের প্রসঙ্গ নির্দেশ করো। উক্তিটি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দাও। (মার্ক ২+৩=৫)
❐ বাংলা ছোটোগল্পের পুরোধা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'গল্পগুচ্ছ' সংকলনের অন্তর্গত ‘ছুটি' গল্প থেকে উদ্ধৃত মন্তব্যটি নেওয়া হয়েছে। বালক-সর্দার ফটিকের পরামর্শমতো মাখনলাল সহ কাঠের গুঁড়ি গড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার খেলা আরম্ভ হলে মাখনের যে তৎক্ষণাৎ বিপদ ঘটতে পারে সেই প্রসঙ্গেই আলোচ্য মন্তব্যটি করা হয়েছে।
কাঠের গুঁড়ির ওপর মাখন নিরীহ দার্শনিকের মতো উদাসীনভাবে বসেছিল। অন্যদের কোনোকথাই সে ভ্রুক্ষেপ করেনি। ফটিক ভয় দেখালেও মাখন ওঠেনি। লেখকের তির্যক মন্তব্য, 'এই অকাল-তত্ত্বজ্ঞানী মানব সকলপ্রকার ক্রীড়ার অসারতা সম্বন্ধে নীরবে চিন্তা করিতে লাগিল।' তার ফলে বালকের দল গুঁড়িটিকে গড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার অনাবিল আনন্দে মত্ত হতে পারছিল না। অবশেষে ছেলের দল যখন মাখন সমেত গুঁড়িটিকে গড়ানোর পরিকল্পনা করল তখন মাখন মনে মনে ভাবল, ইহাতে তাহার গৌরব আছে।' কিন্তু তার বসা অবস্থায় কাঠের গুঁড়ি গড়িয়ে দিলে সে পড়ে যে আঘাত পেতে পারে সেই বিপদ সম্পর্কে সে কিংবা অন্য বালকেরাও অবগত ছিল না। বরং তার মনে হয়েছিল সবাই তাকে বহন করে নিয়ে যাবে। ফলে তার গৌরব বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু গুঁড়ি একপাক ঘুরতে না ঘুরতেই মাখন তাহার গাম্ভীর্য গৌরব এবং তত্ত্বজ্ঞান-সমেত ভূমিস্যাৎ হইয়া গেল।' অচিরেই বিপদের সম্মুখীন হয়ে মাখন প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিল।
___________
৬. ‘বিধবা এ প্রস্তাবে সহজেই সম্মত হইলেন। - বিধবার কাছে কে, কী প্রস্তাব করেছিলেন? তিনি তাতে সম্মত হয়েছিলেন কেন? (মার্ক ২+৩=৫)
❐ 'বিধবা'-টি হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ছুটি' গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফটিক চক্রবর্তীর বিধবা মা। ফটিকের মামা বিশ্বভরবাবু কর্ম উপলক্ষ্যে বহুদিন পশ্চিমে ছিলেন। দীর্ঘকাল পর বাড়ি ফিরে গ্রামে থাকা বোনের সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। বোনের বিয়ের পর সে বাড়িতে তিনি একবারও আসেননি। ইতিমধ্যে ফটিক ও মাখনের জন্ম হয়েছে, তারা বড়ো হয়েছে, ওদের বাবা মারাও গিয়েছে। বোনের সাথে সাক্ষাতে বিশ্বম্ভরবাবু জানতে পারেন যে, বড়ো ভাগ্নে ফটিক অতি দুরন্ত, অবাধ্য, উচ্ছৃঙ্খল ও পাঠে অমনোযোগী এবং মাখন সুশান্ত, সুশীল ও বিদ্যানুরাগী। ফটিককে নিয়ে মায়ের উৎকণ্ঠার শেষ নেই। একথা শুনে বিশ্বস্তরবাবু তাঁর বিধবা বোনকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে, ফটিককে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে নিজের কাছে রেখে পড়াশোনা করাবেন এবং তার মানসিক উন্নতির চেষ্টা করবেন।
দিনের পর দিন দুরস্ত ফটিককে সামলানো মায়ের পক্ষে কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ছিল। ফটিকের অবাধ্যতা ও উচ্ছৃঙ্খল আচরণ মায়ের কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছিল। তাকে নিয়ে মায়ের দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। ফটিকের দুরন্তপনা দিন দিন বেড়েই চলেছিল। মায়ের মনে হত, ফটিকের কারণে কোনোদিন হয়তো তার শান্তশিষ্ট, সুশীল ছেলে মাখনের অনিষ্ট হতে পারে। ফটিকের মা বড়ো উৎকণ্ঠায় বিশ্বম্ভরবাবুকে বলেন, 'ফটিক আমার হাড় জ্বালাতন করিয়াছে।' তাই ফটিক কলকাতায় থাকলে মাখন নিরাপদে থাকবে এবং ফটিকেরও পড়াশোনায় উন্নতির সম্ভাবনা থাকবে—এসব ভেবেই ফটিকের মা তাঁর দাদা বিশ্বম্ভরবাবুর প্রস্তাবে সহজেই সম্মত হয়েছিলেন।
___________
৭. ‘উৎসাহে তাহার রাত্রে নিদ্রা হয় না। —উদ্দিষ্টের উৎসাহের পিছনে লেখক যে ট্র্যাজিক আভাস দিয়েছেন তা বর্ণনা করো। (মার্ক - ৫)
❐ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ছুটি' গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফটিকমামা বিশ্বভার সঙ্গে কলকাতায় যাওয়ার পরম উৎসাহে রাত্রে ঠিকমতো ঘুমোতে পারত না। পল্লিজীবনের গ্রাম্য পরিবেশে বড়ো হয়ে ওঠা ফটিকের কাছে তার আবাল্য পরিচিত ও ভালোবাসার স্মারক ছিল তার জন্মভূমি, উন্মুক্ত প্রকৃতি ও স্বচ্ছন্দ বিচরণক্ষেত্র নদীর ধার। তার দুরন্তপনায় ইতি টানতে ও পড়াশোনায় মন বসাতে বিশ্বম্ভরবাবু তাকে কলকাতায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন বনের পাখিকে খাঁচায় বন্দি করতে। গ্রামীণ জীবন থেকে 'ছুটি' নিয়ে শহর কলকাতার যান্ত্রিক জীবনে যাওয়াই যে তার শেষ যাওয়া, এই পৃথিবীর মুক্ত প্রকৃতিতে সে যে আর ফিরতে পারবে না-লেখক সেই ইঙ্গিতই যেন তার বিদায়ের দৃশ্যে দিয়েছেন। যে ভাইয়ের সাথে তার খুনসুটি লেগেই থাকত, ঠিকমতো বনিবনা হত না, যে ভাইকে সে মিথ্যাবাদী বলে চড় কষিয়েছিল, কলকাতায় যাওয়ার সময় তাকেই পরম আদরে তার খেলার সব সর্যাম দিয়ে গেল।
রবীন্দ্রনাথ বোঝাতে চাইলেন, মানুষ মৃত্যুর পূর্বে যেমন উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করে, ফটিকও তেমনি জীবন থেকে 'ছুটি' নেওয়ার পূর্বে তার প্রাণাধিক প্রিয় সম্পত্তিগুলির উত্তরাধিকারী ছোটো ভাই মাখনকে দিয়ে গেল। লেখক সুকৌশলে এখানেই এ গল্পের ট্র্যাজিক আভাস দিয়ে রাখলেন। মামার বাড়ি যাওয়ার আনন্দের বৈপরীত্যে দিয়ে রাখলেন বিচ্ছেদের করুণ সুরের আভাস। ফটিকের মায়ের বুকে যেন আশঙ্কা বাজল, তিনি ব্যথিত হলেন, ফটিক হাসিমুখে 'ছুটি' নিল।
___________
৮. 'তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই?-মন্তব্যটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো। (মার্ক - ৫)
❐ আধুনিক বাংলা ছোটোগল্পের জনক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ছুটি' গল্পের মুখ্য চরিত্র ফটিক সম্পর্কে উদ্ধৃত মন্তব্যটি করা হয়েছে। তেরো-চোদ্দো বছরের সময়কালটা একটা ছেলের কাছে বয়ঃসন্ধিক্ষণের প্রাথমিক পর্যায়। বালকদের সর্দার ফটিকের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বয়ঃসন্ধির সমস্ত লক্ষণ প্রকাশ করেছেন। এই বয়সের একটি ছেলে, কারও মনে তেমন স্নেহের উদ্রেক করে না; তার সঙ্গসুখ বিশেষ কেউ প্রার্থনাও করে না। সে ক্রমশ বালক থেকে কিশোর হয়ে উঠতে শুরু করে। কিশোরের মনোভূমি প্রকৃতির নিয়মে পরিবর্তিত হয়, তাই শৈশবের লালিত্য স্নান হয়ে কৈশোরের কাঠিন্যে পরিণত হয়। কণ্ঠস্বরের মিষ্টতা পরিণত হয় কর্কশতায়। তার মুখের আধো আধো কথা জ্যাঠামি মনে হয়। তার কথার মধ্যে থাকে প্রগলভতা। শরীর ও মনের এই অনিবার্য পরিবর্তনকে মানুষ ত্রুটি বলে মনে করে।
শৈশবোত্তীর্ণ কিশোর মনে মনে বুঝতে পারে পৃথিবীর কোথাও সে ঠিক মানিয়ে নিয়ে চলতে পারছে না। এজন্য নিজের অস্তিত্ব সম্বন্ধে নিজের কাছেই সে লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে থাকে। জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তার মন স্নেহকাতর হয়ে থাকে, একটু স্নেহ বা সখ্যতা পেলেই নিজেকে বিকিয়ে দেয়। কিন্তু এমন স্নেহপ্রবণ ব্যক্তি দুর্লভ। এইসময় নারীজাতিকে ‘স্বর্গলোকের দুর্লভ জীব' বলে মনে হয়। মায়ের কোল ছাড়া বাকি সব জায়গা নরক মনে হয়। ‘ছুটি' গল্পে মাকে ছেড়ে আসা ফটিকের মানসপটের শাশ্বত ছবি রবীন্দ্রনাথ এভাবেই চিত্রিত করেছেন।
___________
৯. ‘অতএব তাঁহাদের নিকট হইতে উপেক্ষা অত্যন্ত দুঃসহ বোধ হয়। – কোন প্রসঙ্গে কথাটি বলা হয়েছে? মন্তব্যটি ব্যাখ্যা করো। (মার্ক ২+৩=৫)
❐ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত 'ছুটি' গল্পে সদ্য শৈশব থেকে কিশোর হয়ে ওঠা ফটিক চক্রবর্তীর মানসিক গঠন ও শারীরিক পরিবর্তন প্রসঙ্গে আলোচ্য মন্তব্যটি করা হয়েছে। গ্রামজীবন পরিত্যাগ করে ফটিক কলকাতায় পড়াশোনার তাগিদে মামার আশ্রয়ে উঠেছিল। ফটিকের আগমনে মামী বেশ অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তেরো-চোদ্দো বছরের ছেলের মতো এমন বালাই পৃথিবীতে আর নেই। বয়ঃসন্ধির দোরগোড়ায় উপস্থিত এই বয়সের বালকেরা স্নেহের জন্য কাতর হয়ে ওঠে। এই সময় কোনো সহৃদয়ের সখ্যতা বা স্নেহ পেলে তারা তার কাছে ক্রীতদাস হয়ে থাকতে পারে।
এমন অবস্থায় মাতৃভবন ছাড়া অন্য কোনো অপরিচিত জায়গা বালকের কাছে নরক। মামীর স্নেহহীন চোখে ফটিক সর্বদাই দুর্গ্রহের মতো প্রতিভাত হত। ফটিক বুঝাতে পেরেছিল মামী তাকে ভালোবাসে না। চারদিকের স্নেহশূন্য বিরাগ প্রতি মুহূর্তে তাকে কাঁটার মতো বিধত। ফটিকের বয়সে নারীজাতিকে সাধারণত স্বর্গলোকের শ্রেষ্ঠ জীব বলে ধারণা হয়; উদার প্রশস্ত শ্রদ্ধেয় কল্পনার চোখে নারীজাতি প্রতিভাত হয়। কিন্তু ফটিক মামীর আশ্রয়ে থেকেও তা থেকে বঞ্চিত। বরং মামীর অনাদর ও উপেক্ষা ফটিকের অত্যন্ত দুঃসহ বলে মনে হয়েছে।
___________
১০. ‘ফটিক খালাসিদের মতো সুর করিয়া বলিতে লাগিল, এক বাও মেলে না, দো বাও মেলে-এ-এ না। —ফটিকের এই উক্তি গল্পে কতটা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে আলোচনা করো। (মার্ক - ৫)
❐ পরিপ্রকৃতির অবাধ ও উন্মুক্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠা ফটিকের প্রাণপাখি সম্পূর্ণরূপে বাঁধা পড়েছিল পল্লিজীবনের অনাবিল আনন্দের মধ্যে। গ্রামজীবনের মুক্তির আনন্দ ছেড়ে একসময় ফটিক তার মামার সঙ্গে কলকাতার যান্ত্রিক পরিবেশে চলে আসে। মুক্ত পাখি যেন খাঁচায় বন্দি হয়ে যায়। নদীপথে কলকাতায় আসার সময় ফটিক অবাক দৃষ্টিতে দেখেছিল জল মাপার জন্য খালাসিরা সুর করে বলছিল, “এক বাঁও মেলে না। দো বাঁও মেলে –এ–এ না ।”
কলকাতার বন্দিদশা ফটিকের কাছে আরও প্রকট হয়ে উঠেছিল মামীর রুষ্ট আচরণে। ফটিক গ্রামে ফিরতে চায়। পল্লির স্বাধীন জীবন তাকে হাতছানি দেয়। ফটিক বুঝতে পারে সে যেন কোথাও ঠিক খাপ খাওয়াতে পারছে না। কলকাতায় মামার বাড়িতে আসার জন্য যে ফটিক একদিন আনন্দে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিল, সেই-ই আবার গ্রামে ফেরার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তাই কাউকে কিছু না-জানিয়ে ঝড়জলের রাতে একা বেরিয়ে পড়ে, ‘পরদিন প্রাতঃকালে ফটিককে আর দেখা গেল না। পুলিশের গাড়ি যখন তাকে আবার মামার বাড়ি পৌঁছে দেয় সে যেন শহরের যান্ত্রিকতার, নিষ্ঠুরতার প্রতি প্রতিবাদ জানাতেই ঘোর প্রলাপে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। মুমূর্ষু অবস্থায় তার প্রলাপের ভাষা হয়ে ওঠে মাঝিদের মুখ থেকে শোনা সেই কথাগুলি, “ফটিক প্রলাপে তাহাদেরই অনুকরণে করুণস্বরে জল মাপিতেছে এবং যে অকূল সমুদ্রে যাত্রা করিতেছে, বালক রশি ফেলিয়া কোথাও তাহার তল পাইতেছে না।” যে ভবসমুদ্রে ফটিক পাড়ি দিতে চলেছে সে সমুদ্রের জল অতলান্ত, কাছি দিয়ে তার পরিমাপ করা যায় না। তাই নিষ্ঠুর পৃথিবী থেকে চির ‘ছুটি’ চায় ফটিক।
___________
১১.‘মামা, আমার ছুটি হয়েছে কি? – প্রসঙ্গ নির্দেশ করে ''ছুটি' শব্দটির ব্যঞ্জনার্থ বুঝিয়ে দাও। (মার্ক ২+৩=৫)
❐ পড়াশোনার উন্নতি ও মানসিক উৎকর্ষ সাধনের জন্য পিতৃহারা ফটিককে তার মামা বিশ্বম্ভরবাবু কলকাতায় নিয়ে আসেন। কিন্তু মামীর নিদারুন অত্যাচার ও অনাদরে ফটিকের জীবন দুঃসহ হয়ে ওঠে। গ্রাম্য মুক্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠা ফটিক যান্ত্রিক মমতাহীন কলকাতায় মামার বাড়ির পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না, ক্রমশ হাঁপিয়ে ওঠে। মামাকে তাই সে প্রায়ই বলত মায়ের কাছে নিয়ে যেতে। মামা সান্ত্বনা দিয়ে বলতেন কার্তিক মাসে পুজোর ছুটি হলেই নিয়ে যাবেন। স্নেহহীন বন্ধ জীবন থেকে ছুটি নিয়ে গ্রাম্য সবুজের স্পন্দনে তার ভবঘুরে মন বারবার ফিরে যেতে চেয়েছে। ফটিকের উপরোক্ত প্রশ্নটির অবতারণা সে প্রসঙ্গেই।
কলকাতার নীরস পরিবেশে মামীর নির্মম ব্যবহারে ব্যথিত ফটিক মায়ের কোলে ফেরার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। স্কুলের ছুটি পড়ার অপেক্ষায় সে দিন গুনতে থাকে। ছুটির দিন আর আসে না। কার্তিক মাসে পুজোর ছুটি এখনও দেরি আছে। কিন্তু ফটিকের ছুটি চায়। লেখক সুকৌশলে ‘ছুটি’ কথাটি ব্যঙ্গার্থে প্রয়োগ করে বান্ত্বনা সৃষ্টি করেছেন। 'ছুটি' শব্দের অর্থ বন্দনহীন মুক্তি। বন্ধ প্রাণের মুক্তি, সমস্ত শাসন-বন্ধন থেকে মুক্তি, অনাবিল আনন্দলোকে প্রাণের মুক্তি। ফটিক পুজোর ছুটির জন্য ব্যাকুলভাবে অপেক্ষা করেছিল। তার আগেই চিরদিনের জন্য সমস্ত মায়ার বন্ধন থেকে ছুটি পেয়ে যায়। এ ছুটি বিদ্যালয়ের সাময়িক ছুটি নয়- নাগরিক জীবনের হৃদয়হীনতা থেকে ছুটি, স্কুলের মাস্টারমশাইদের ব্যঙ্গ আর নিপীড়নের হাত থেকে ছুটি, স্নেহহীন মামীর উপেক্ষা থেকে ছুটি—পৃথিবীর কাছ থেকে পাওয়া অনন্তকালের ছুটি। ফটিকের অকালমৃত্যুতে 'ছুটি' কথাটি যেন গভীর ব্যঞ্জনাবহ হয়ে ওঠে আলোচ্য গল্পে।
___________
১২. 'ছুটি' গল্পে বিশ্বভরবাবুর ভূমিকা আলোচনা করো। (মার্ক - ৫)
❐ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ছুটি' গল্পে অপ্রধান চরিত্র হিসেবে বিশ্বঙ্করবাবুর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। গল্পের মুখ্য চরিত্র ফটিকের মামা তিনি। ফটিকের জীবনের বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে মামা বিশ্বম্ভরবাবুর ঘনিষ্ঠ যোগ আছে। ফটিকের জীবনের ভাবী পরিণতির জন্য এই চরিত্রটি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। বিশ্বম্ভরবাবু অর্ধবয়সী, কাঁচা গোঁফ এবং পাকা চুল। নদীর ঘাটে নৌকা থেকে নেমে ফটিকের সঙ্গে তাঁর প্রথম আলাপ হয়। কিন্তু কেউ কাউকে চিনতে পারেনি। ফটিকদের বাড়িতে মা-ছেলেতে কলহ উপস্থিত হওয়ার সন্ধিক্ষণে বিশ্বম্ভরবাবু প্রবেশ করেন এবং জানা যায়, তিনি ফটিকের মায়ের দাদা অর্থাৎ ফটিকের মামা। বহুদিন কর্ম উপলক্ষ্যে তিনি পশ্চিমে ছিলেন। কলকাতায় ফিরে বোন ও ভাগ্নেদের দেখতে এসেছেন। মামার উপস্থিতিতে ফটিকদের কয়েকদিন বেশ সমারোহে কেটেছিল।
ছোটোবোনকে তিনি যথেষ্ট ভালোবাসতেন। তাই বোনের কাছ থেকে যখনই জানতে পারলেন যে, বড়ো ভাগ্নে ফটিক অবাধ্য, উচ্ছৃঙ্খল, দুরন্ত ও পাঠে অমনোযোগী, তিনি তখনই প্রস্তাব দিলেন ফটিককে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে তাঁর কাছে রেখে পড়াশোনা করাবেন। বিশ্বম্ভরবাবুর প্রস্তাবে ফটিক ও তার মা দুজনেই রাজি হয়ে যায়। বিশ্বম্ভরবাবুর তিন সন্তান। দুর্মূল্যের বাজারে তিনি ফটিকের খাওয়া-পরা ও লেখাপড়ার দায়িত্ব নিজের একার আয়ের ওপর নির্ভর করে গ্রহণ করেছিলেন। ফটিককে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করতেন। এখানে তাঁর মহৎ হৃদয় ও দয়ালু মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু তিনি নির্বিবাদী। ফটিকের আগমনে তাঁর স্ত্রী যে অসন্তুষ্ট ও ফটিকের সাথে নির্মম ব্যবহার করতেন তা জেনেও তিনি প্রতিবাদ করেননি।
শহর কলকাতা ফটিককে শান্তি দেয়নি। সে মায়ের কাছে ফিরে যেতে চাইলে বিশ্বশুরবাবু তাকে আশ্বস্ত করে বলেছিল, 'স্কুলের ছুটি হোক।' স্কুলের ছুটি হওয়ার আগেই ফটিক প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হয়। চিকিৎসক ডাকেন বিশ্বম্ভরবাবু। ফটিকের মাকেও খবর দেন। ফটিক যখন চোখ লাল করে জিজ্ঞাসা করে ‘মামা আমার ছুটি হয়েছে।' তখন বিশ্বম্ভরবাবু চোখ মুছে সস্নেহে ফটিকের শীর্ণ হাতটি নিজের হাতের ওপর তুলে নিয়েছিলেন। মানবিক হৃদয়ের নিদর্শন হিসেবে এখানে তাঁর সহানুভূতিশীল মনের পরিচয় পাওয়া যায়। স্তিমিত প্রদীপে রোগশয্যায় বসে ফটিকের মায়ের জন্য তিনি প্রতিটা মুহূর্ত অপেক্ষা করেছেন। মানবদরদী আদর্শ মানুষ হিসেবে গল্পে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
___________
১৩. ‘প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের নিগূঢ় আত্মিক সম্পর্কের গভীর তাৎপর্য ব্যাপ্ত হয়ে আছে গল্পটির সর্বাঙ্গে। -আলোচ্য উক্তির পরিপ্রেক্ষিতে ‘ছুটি” গল্পের প্রাকৃতিক রূপ আলোচনা করো। (মার্ক - ৫)
❐ জমিদারি কর্মসূত্রে রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের বিস্তীর্ণ পরিপ্রকৃতির সান্নিধ্যে বহুদিন জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। সাজাদপুরে থাকাকালীন নিভৃতে বোটে ভাসতে ভাসতে তাঁর চোখে দেখা এক টুকরো দৃশ্যে কল্পনার রং মিশিয়ে তিনি তৈরি করেছেন ‘ছুটি' গল্পটি। প্রকৃতি ও মানুষ যেন এখানে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত—একে অপরের পরিপুরক। বোটের জানালা দিয়ে নদীর ধারে তিনি যে দুরন্ত, অবাধ্য, উচ্ছৃঙ্খল বালকটিকে দেখেছিলেন, সেই বালকটিই হয়েছে তাঁর গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফটিক। ওই দুরন্ত বালকটির মধ্যে রবীন্দ্রনাথ মুক্ত প্রকৃতিতে উচ্ছল প্রাণের মুক্তির যে তাগিদ দেখেছিলেন সেটাই তার কাহিনির মূল বিষয়বস্তু।
গল্পের কাহিনিতে দেখা যায়, প্রকৃতির কোলে আজন্ম লালিত বালক ফটিককে প্রকৃতির কোল থেকে জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে যায় শহরবাসী মামা। প্রাকৃতিক বন্ধন ছিন্ন হওয়ায় যন্ত্রণায় ও কষ্টে ফটিকের ‘আত্মিক মৃত্যু’ ঘটে এবং কিছুদিন পরে এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে ‘দৈহিক মৃত্যু’ ঘটে। মুক্ত প্রকৃতি যেন ফটিকের জীবনের সঙ্গে একাত্ম হয়েছিল এই গল্পে। খোলা আকাশ, নির্মল বাতাস, শান্ত নদীতীরে সঙ্গীসাথিদের নিয়ে কলরব সহকারে খেলা, নৌকার আনাগোনা ফটিককে ভীষণভাবে আকর্ষণ করত। দুরন্ত ফটিক গ্রাম্য প্রাকৃতিক পরিবেশে সর্বদা যেন মুক্তির স্বাদ আস্বাদন করত। প্রকৃতির শ্যামস্নিগ্ধ স্নেহময়তা থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে নাগরিক জীবনের একঘেয়ে নির্দয় নির্মম পরিবেশে নিয়ে গেলে সে যেন হাঁপিয়ে ওঠে। ছুটি নিয়ে চলে যেতে চায় প্রকৃতির সন্নিধ্যে। ফটিকের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ যেন বোঝাতে চেয়েছেন, প্রকৃতির যে অমৃতলোক থেকে ফটিকের আগমন মৃত্যুর পরে সেই অনন্ত প্রকৃতির কোলে পুনরায় প্রত্যাবর্তন। শহরের যান্ত্রিকতা, নিষ্ঠুরতা তাকে বেঁধে রাখতে পারেনি। তাই সে ছুটি চেয়েছে অনন্তকালের জন্য। গল্পে প্রকৃতি ও মানুষের এই আত্মিক বন্ধন গল্পটিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।
Class - XI Bengali (2nd Semester) | |
---|---|
গল্প | |
ছুটি | Click Here |
তেলেনাপোতা আবিষ্কার | Click Here |
কবিতা | |
ভাব সম্মিলন | Click Here |
লালন শাহ্ ফকিরের গান | Click Here |
নুন | Click Here |
নাটক | |
আগুন | Click Here |
পূর্ণাঙ্গ সহায়ক গ্রন্থ : পঞ্চতন্ত্র | |
বই কেনা | Click Here |
আজব শহর কলকেতা | Click Here |
পঁচিশে বৈশাখ | Click Here |
আড্ডা | Click Here |
বাংলা শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাস | তৃতীয় অধ্যায় : আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ধারা-গদ্যসাহিত্য | কাব্য কবিতার ধারা | বাংলা নাটক ও যাত্রার ধারা | উপন্যাস ও ছোটোগল্প | চতুর্থ অধ্যায় : লৌকিক সাহিত্যের নানা দিক | প্রবন্ধরচনা |মানস-মানচিত্র অনুসরণে -বিতর্কমূলক
বাংলা শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাস | |
---|---|
তৃতীয় অধ্যায় : আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ধারা | |
গদ্যসাহিত্য | Click Here |
কাব্য কবিতার ধারা | Click Here |
বাংলা নাটক ও যাত্রার ধারা | Click Here |
উপন্যাস ও ছোটোগল্প | Click Here |
চতুর্থ অধ্যায় : লৌকিক সাহিত্যের নানা দিক | Click Here |
প্রবন্ধরচনা | |
Click Here |
___________
১৪. 'ছুটি' গল্পে ফটিকের মামীর চরিত্রবিশ্লেষণ করো। (মার্ক - ৫)
❐ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ছুটি' গল্পে অপ্রধান চরিত্র হিসেবে বিশ্বম্ভরবাবুর স্ত্রী অর্থাৎ ফটিকের মামীর চরিত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গল্পে তাঁকে আমরা বিশ্বম্ভরবাবুর বিপরীতধর্মী চরিত্র হিসেবে দেখতে পাই। তার চরিত্রের বিশেষ কিছু দিক আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
◑ স্বার্থপরতা : বিশ্বম্ভরবাবুকে গল্পে যেমন আদর্শ দয়ালু মানুষ হিসেবে পাই তাঁর স্ত্রী তেমন নন। তাঁর মধ্যে ছিল চরম স্বার্থপরতা। তিনি নিজের সন্তান ছাড়া কিছুই বুঝতেন না। তেরো বছরের ফটিক মামীর স্নেহ পেলে নিজেকে ধন্য মনে করত। কিন্তু ‘মামীর স্নেহহীন চক্ষে সে যে একটা দূর্গ্রহের মতো প্রতিভাত হইতেছে,' এ কথা ভেবে ফটিক দুঃখ ও কষ্ট পেয়েছে।
◑ মাতৃত্বের অভাব : বিশ্বম্ভরবাবুর তিনটি সন্তান থাকা সত্ত্বেও তিনি ফটিকের লেখাপড়ার জন্য অনাবশ্যকভাবে তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেলে মামী অসন্তুষ্ট হন। এমনকি বিশ্বম্ভরবাবুর প্রতিও রুষ্ট হন। ফটিককে তিনি নিজের সন্তানদের মতো মনে করতে পারেননি। ফটিকের মতো অপরিচিত অশিক্ষিত পাড়াগেঁয়ে’ ছেলে বাড়িতে থাকলে যে বিপ্লবের সম্ভাবনা উপস্থিত হতে পারে সেই সংশয় ছিল মামীর মধ্যে। তাই ফটিকের প্রতি যে নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা ও অবিচারমূলক আচরণ তিনি করেছেন তাতে তাঁর মাতৃভাবের অভাব প্রকট হয়। ফটিকের প্রতি সামান্যতম ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা তাঁর ছিল না।
◑ বৈমাত্রেয়সুলভ আচরণ : ফটিকের কাছে মামী হলেন মাতৃসমান। কিন্তু ফটিকের স্বাভাবিক অনিবার্য ত্রুটি মামী সহ্য করতে পারতেন না। ফটিক মামীকে কিছু সাহায্য করার চেষ্টা করলে মামী তা উপেক্ষার সঙ্গে পরিহার করতেন। মামীর ধারণা হয়েছিল ফটিক তাদের বাড়িতে আসার পর তাঁদের অর্থনৈতিক টানাপোড়েন শুরু হয়। একবার স্কুলের একটি বই হারিয়ে ফেলায় মামী বিরক্তির স্বরে বলেছিলেন, “বেশ করেছ, আমি তোমাকে মাসের মধ্যে পাঁচবার করে বই কিনে দিতে পারিনে।” মাতৃসমা মামীর থেকে সে মায়ের মতো আচরণ পায়নি।
◑ নির্দয়তা : ফটিকের প্রতি মামী ছিলেন নির্দয়। শ্রাবণের বৃষ্টিধারায় অসুস্থ ফটিককে পুলিশের লোক গাড়ি থেকে নামালে বিশ্বম্ভরবাবু প্রায় কোলে করে ফটিককে অন্তঃপুরে নিয়ে যান। কিন্তু মামীর তাতে কোনো দুঃখ বা সহানুভূতি ছিল না। বরং রেগে গিয়ে বলেন, ‘কেন বাপু, পরের ছেলেকে নিয়ে কেন এ কর্মভোগ। দাও ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দাও।' অসুস্থ ফটিককে নিয়ে তার মামার মধ্যে যে দুশ্চিন্তা তার সামান্যতম মামীর মধ্যে দেখা যায় না। এমন নির্দয় চরিত্রের মানুষ ছিলেন ফটিকের মামী।
___________
Tags : class 11 bengali 2nd semester suggestion 2025,একাদশ শ্রেণি বাংলা,class 11 2nd semester, একাদশ শ্রেণির বাংলা,একাদশ শ্রেণির বাংলা কবিতা,একাদশ শ্রেণি 2nd সেমিস্টার বাংলা প্রশ্নপত্রের ধরণ,,class 11 2nd semester bengali,একাদশ শ্রেণির বাংলা সিলেবাস সেমিস্টার : ২,একাদশ শ্রেণির বাংলা কবিতা সাম্যবাদী mcq,একাদশ শ্রেণি বাংলা সাজেশন ২০২৫,class 11 bangla syllabus 2nd semester,class 11 bengali 2nd semester syllabus, ছুটি গল্প,ছুটি গল্প রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,একাদশ শ্রেণির বাংলা গল্প ছুটি,ছুটি একাদশ শ্রেণী,একাদশ দ্বিতীয় সেমিস্টার বাংলা গল্প ছুটি,ছুটি গল্প রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাদশ শ্রেণী বাংলা সেমিস্টার 2,একাদশ শ্রেণির বাংলা ছুটি গল্প,একাদশ শ্রেণির বাংলা গল্প ছুটি সম্পূর্ণ আলোচনা,ছুটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর