Class 11 Bengali Telenapota Abishkar 2nd-Semester Question Answer

Esita Afrose
0
 

তেলেনাপোতা আবিষ্কার গল্প একাদশ শ্রেণী | প্রেমেন্দ্র মিত্র | Telenapota Abiskar (Premendra Mitra) Class : XI  2nd-Semester Notes

❐ তেলেনাপোতা আবিষ্কারগল্পের বিষয়বস্তু :  কোনও এক শনিবার বা মঙ্গলবার, সম্ভবত মঙ্গলবারই, গল্পকথক খোঁজ পেয়েছিলেন তেলেনাপোতা নামক এক জায়গার। প্রাত্যহিক কাজকর্ম এবং শহুরে ভিড় ভাট্টায় হাঁপিয়ে উঠেছিলেন গল্পকথক। এমন সময়ে দুদিনের জন্য কাজ থেকে অবসরও পেয়ে গেলেন তিনি। তখনই তাঁর এক বন্ধু তাঁকে লোভ দেখালেন তেলেনাপোতা আবিষ্কারের। মাছ ধরার নেশা গল্পকথকের খুব বেশি হলেও পুঁটি মাছ ছাড়া অন্য কোনো মাছ ধরার সৌভাগ্য কখনও তাঁর হয়নি। তাঁকে তাঁর বন্ধু জানালেন যে, তেলেনাপোতার দিঘিতে ইতিপূর্বে কেউ কখনও বড়শি দিয়ে মাছ ধরেনি বলে সেখানকার মৎস্যকুল বড়শিবিদ্ধ হওয়ার জন্য ব্যগ্র হয়ে রয়েছে। সুতরাং বন্ধুর কথায় উৎসাহী হয়ে তেলেনাপোতা-আবিষ্কারে বেরিয়ে পড়লেন গল্পকথক। এ অভিযানে গল্পকথকের সঙ্গে দু-জন সহচরও আসেন। তাঁরা অবশ্য কেউই তাঁর মতো মৎস্য-শিকারি বা মৎস্যলোভী নন। তাঁদের এখানে আসার আলাদা কারণ ছিল।

ভাদ্র মাসের কোনও এক বিকেলে জিনিসে-মানুষে ঠাসাঠাসি একটি বাসে, পথের ঝাঁকুনি ও মানুষের ঠেলা খেতে খেতে প্রায় দু-ঘণ্টা পরে তাঁরা নামেন তেলেনাপোতার নিকটবর্তী এক বাস স্টপে। কিছুক্ষণ পরেই সেখানকার অন্ধকার এমন ঘনীভূত হয়ে পড়ল যে, পরস্পরের মুখও আর দেখা গেল না। মশাদের আক্রমণ আরও ধারালো হয়ে উঠল। বিরক্ত হয়ে গল্পকথক মনে মনে ভাবতে লাগলেন, বড়ো রাস্তায় চলে গিয়ে কলকাতা ফেরার কোনো বাস ধরার চেষ্টা করবেন। তখনই সেই জঙ্গলের ভেতরকার সরু রাস্তার শেষপ্রান্ত থেকে অপূর্ব এবং শ্রুতিবিস্ময়কর একটা শব্দ তিনি শুনতে পেলেন। সে শব্দ শুনে তাঁর মনে হল, নিস্তব্ধ বনভূমি থেকে কেউ যেন এক অমানবিক ক্ৰন্দন অতি কষ্টে একটু একটু করে প্রকাশিত করছে।

শব্দটা শুনে তিনবন্ধুই প্রত্যাশায় অস্থির হয়ে উঠলেন। তাঁদের সে প্রত্যাশা ফলপ্রসূও হল। প্রথমে অস্পষ্ট অন্ধকারে একটা সূক্ষ্ম আলো দুলতে দেখা গেল। তারপর দেখা গেল একটা গোরুর গাড়ি জঙ্গলের ভেতর থেকে শ্লথ, শান্ত, দোলায়মান গতিতে তাঁদের দিকে এগিয়ে আসছে। গোরুর গাড়িটি সামনে এলে গল্পকথক সেই গাড়িটি এবং গোরু দুটি দেখে ভাবলেন যে, ভূগর্ভের কোনো ‘বামনের দেশ’। থেকে যেন গোরুর গাড়ির এই ক্ষুদ্র রূপটি বের হয়ে এসেছে। এরপর তাঁরা গোরুর গাড়ির অপ্রশস্ত ছই-এর ভেতরে কোনোক্রমে গাদাগাদি করে বসলেন। সেটি যে পথে এসেছিল, সেই জঙ্গলে ঘেরা পথেই ফিরে চলতে শুরু করল। গল্পকথক অবাক হয়ে দেখতে লাগলেন, ঘনান্ধকার জঙ্গল যেন সুড়ঙ্গের মতো অপরিসর পথ একটু একটু করে উদ্‌ঘাটিত করছে।

দূরে গোরুর গাড়ির ঝাঁকুনিতে গল্পকথকের সঙ্গে তাঁর বন্ধুদের ঠোকাঠুকি ঘটতে লাগল মাঝে মাঝেই। এরপর ক্রমশ তিনি অনুভব করলেন যে, চারপাশের জমাট অন্ধকারে তাঁর চেতনার শেষ স্তরটিও বুঝি ডুবে গেল ৷ চেনাজানা দুনিয়াকে যেন তিনি কোথাও ফেলে রেখে এসেছেন। হঠাৎ এক সময় উগ্র এক বাজনার ঝন্ ঝন্ শব্দে জেগে উঠে তিনি দেখলেন যে, ছই-এর মধ্যে বসেই আকাশের তারা দেখা যাচ্ছে এবং গোরুর গাড়ির চালক মাঝে মাঝেই উদ্দীপিত হয়ে ক্যানেস্তারা বাজাচ্ছে। গল্পকথক আগ্রহী হয়ে এর কারণ জানতে চাইলে গাড়োয়ান একান্ত ভাবলেশহীনভাবে জানায় যে, চিতাবাঘ তাড়ানোর জন্যই তার ক্যানেস্তারা বাজানো। কারণ, নিতান্ত ক্ষুধার্ত না থাকলে চিতাবাঘ ক্যানেস্তারার শব্দেই সরে পড়ে।

কলকাতা মহানগর থেকে মাত্র ত্রিশ মাইল দূরে এমন ব্যাঘ্র- সংকুল স্থান থাকা যে নিতান্তই অভাবিত—একথা যখন গল্পকথক চিন্তা করছিলেন, তখন গোরুর গাড়িটি একটা বিরাট মাঠ পার হচ্ছিল। কৃষ্ণপক্ষের বিলম্বিত, ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের দেখাও তখন পাওয়া গেল। সেই চাঁদের আলোয় গল্পকথক দেখতে পেলেন যে, চলমান গোরুর গাড়ির দুপাশে পুরোনো মন্দির এবং প্রাসাদের বিভিন্ন ভগ্নাংশ, যেমন স্তম্ভ, দেউড়ির খিলান ইত্যাদি, মহাকালের সাক্ষী হবার বৃথা আশায় দাঁড়িয়ে আছে। তাই মাথাটা যথাসম্ভব উঁচু করে উৎসুক দৃষ্টিতে গল্পকথক দুপাশের সেইসব দৃশ্য দেখতে থাকলেন এবং সারা দেহে কেমন একটা রোমাঞ অনুভব করলেন। বর্তমানের এই পৃথিবীতে যেন তিনি নেই, পরিবর্তে পুরাকালের কোনো কুয়াশাচ্ছন্ন স্মৃতি-চিত্রপট যেন তার চোখের সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে।

দুতিনবার বাঁক ঘুরে গোরুর গাড়িটি অবশেষে একটি জীর্ণ অট্টালিকার সামনে এসে দাঁড়াল। সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাসাদেরই তুলনামূলক-বাসযোগ্য একটি ঘরে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা হল। গোরুর গাড়ির গাড়োয়ান একটা ভাঙা লণ্ঠন নিয়ে এসে সে ঘরে বসিয়ে দিল। সেইসঙ্গে এককলশি খাবার জল। ঘরে ঢুকে তিন বন্ধুই বুঝতে পারলেন যে, বহু যুগ পরে সে ঘরে আবার মানুষের পায়ের ধুলো পড়ল। ঘরটির ঝুল-কালি, ধুলো এবং আবর্জনা হয়তো ইতিপূর্বে কেউ পরিষ্কার করবার ব্যর্থ চেষ্টা করে গেছে। সে-ঘরের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর আত্মা যে তাতে ক্ষুণ্ন হয়েছে, একটা অপরিস্ফুট ভ্যাপসা গন্ধ যেন তারই সাক্ষ্য দিচ্ছে। একটু-আধটু হাঁটাচলা করলেই ঘরটির ছাদ ও দেয়াল থেকে ভাঙা প্লাস্টার তাদের দেহের ওপর খসে পড়তে লাগল। এই প্লাস্টার বর্ষণ যেন সেই রুষ্ট আত্মারই অভিসম্পাত। ঘরটির অধিবাসী দু-তিনটি চামচিকা সারা রাত ধরে গল্পকথকদের সঙ্গে বসবাসের অধিকার নিয়ে লড়াই চালিয়ে যায়।

গল্পকথকের এক বন্ধু মদ্যপানাসক্ত, অন্যজন ঘুমকাতুরে কুম্ভকর্ণের সহচর। ঘুমকাতুরে বন্ধুটি মেঝেতে সতরঞ্জি পড়ার সঙ্গে-সঙ্গেই, সেখানে নিজেকে সঁপে দিয়ে নাক ডাকতে শুরু করে দেন। অন্যজন পানপাত্রে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে নিয়োজিত করেন। এদিকে গল্পকথকের কিন্তু ঘুম আসতে চায় না। রাত বেড়ে চলে ৷ ভাঙা লণ্ঠনের চিমনি ক্রমে ক্রমে ঘন কালিতে ভরে যায় এবং শেষে একসময় তা নিভে যায়। সেস্থানের পূর্ণবয়স্ক সক্ষম মশার দল গল্পকথকদের অভিবাদন জানাতে আসে এবং তাঁদের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক স্থাপন করে চলে। দূরদর্শী গল্পকথক দেয়ালে এবং শরীরে তাদের বসার ভঙ্গিমা দেখে বুঝতে পারেন যে, তারা ম্যালেরিয়া রোগের বাহক কুলীন অ্যানোফিলিস মশা। মশা ও গুমোট গরম থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কথক টর্চ হাতে ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে বাড়ির ছাদে ওঠার উপক্রম করেন। কিন্তু ওপরে ওঠবার সময়ে মাঝে মাঝেই এদিক-ওদিক থেকে ইট বা টালি খুলে পড়তে থাকায় তাঁর আহত হয়ে পড়ে যাবার আশঙ্কা তৈরি হয়। কিন্তু তবুও তিনি ক্ষান্ত হন না। কোনো এক দুর্নিবার আকর্ষণে তিনি ভয়কে অগ্রাহ্য করে ছাদে উঠে যান। 

ছাদে গিয়ে গল্পকথক দেখেন, ছাদের আলিশা অনেক জায়গাতেই ভাঙা। আলিশা এবং ছাদের মাঝখানের ফাটলগুলিতে এমনভাবে সব গাছ গজিয়ে উঠেছে যে, তাদের চক্রান্তমূলক শিকড় ভেতরে ভেতরে জীর্ণ প্রাসাদটিকে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে চলেছে। এসব সত্ত্বেও, কৃষ্ণপক্ষের ম্লান জ্যোৎস্নায় চারদিকটা কেমন যেন অপূর্ব মোহময় হয়ে উঠেছে। গল্পকথকের মনে হল যেন, এই মরণ-নিদ্রায় আচ্ছন্ন ছলনাপুরীর কোনো গোপন কক্ষে কারারুদ্ধ রাজকুমারী সোনার কাঠি ও রুপোর কাঠি পাশে নিয়ে যুগ-যুগান্তরের গভীর নিদ্রায় অচৈতন্য হয়ে আছে। গল্পকথকদের আস্তানা গাড়া প্রাসাদেরই পাশের সরু রাস্তার ওপারের যে ভাঙা বাড়িটিকে এর আগে পর্যন্ত তাঁর ভগ্নস্তূপ বলে মনে হয়েছিল, তারই একটি জানলায় হঠাৎই একটি ক্ষীণ আলোকরেখা দেখা যায়। গল্পকথক দেখলেন, সেই আলোকরেখা আড়াল করে একটি রহস্যময় অশরীরী মূর্তি সেখানে এসে দাঁড়ায়। গভীর রাত্রে জানালা-পাশে দাঁড়ানো ছায়ামূর্তিটি কার, কেনই বা সেই নারীর চোখে ঘুম নেই—এসব কথার কোনো সদুত্তর পেলেন না গল্পকথক। কিছুক্ষণ পরে অবশ্য তাঁর অনুভব হবে যে, সেটা হয়তো বা তাঁর দৃষ্টিভ্রম। কেন-না, কিছুক্ষণের মধ্যেই জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ছায়ামূর্তি সরে যায়, আলোর রেখাও যায় মুছে। গল্পকথকের মনে হয়, এই ধ্বংসপুরীর গভীর নিদ্রা থেকে একটি স্বপ্নের জলবিম্ব ক্ষণিকের জন্য যেন জাগ্রত জগতে ভেসে উঠে আবার মিলিয়ে গেল। গল্পকথক এরপর সাবধানে নীচে নেমে আসেন এবং তারপর ঘুমন্ত দুই বন্ধুর পাশে একটু জায়গা করে একসময় ঘুমিয়েও পড়েন।

পরদিন সকালে বড়শি এবং মাছ ধরার বাকি উপকরণ সঙ্গে নিয়ে তিনি পাশের পুকুরে যান। সেখানকার শ্যাওলায়-ঢাকা, ভাঙা ঘাটে বসে কচুরিপানা-পূর্ণ জলে ছিপ ফেলেন। বেলা বাড়তে থাকে। পুকুরটির অন্য পারে নুয়ে-পড়া একটি বাঁশের আগায় বসে থাকা একটি মাছরাঙা পাখি মাঝে মাঝেই পুকুরের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল এবং ঠোঁটে মাছ নিয়ে সার্থকতার আনন্দে আবার বাঁশের মাথায় ফিরে যাচ্ছিল। মাছরাঙাটির এই আচরণ দেখে গল্পকথকের মনে হয় যে, পাখিটি তাঁকে পরিহাস এবং বিদ্রুপ করবার জন্যই এমনটা করছে। একটা মোটা লম্বা সাপ তাঁকে চমকে দিয়ে ভাঙা ঘাটটির কোনো ফাটল থেকে বেরিয়ে। ধীর-স্থির ভাবে সাঁতরে পুকুরের ওপারে গিয়ে উঠে। দুটো ফড়িং যেন প্রতিযোগিতা করে তাদের পাতলা-কাচের-মতো পাখা নেড়ে গল্পকথকের বড়শির ফাতনার ওপর বসার চেষ্টা করতে থাকে। থেকে থেকে ডাকা ঘুঘুপাখির বিষণ্ণ ডাকে আনমনা হয়ে যান গল্পকথক।

হঠাৎই জলের শব্দ শুনে চমক ভেঙে তিনি দেখেন যে, স্থির জলে ঢেউ উঠছে এবং তাঁর বড়শির ফাতনা ধীরে ধীরে দুলছে। এরপর ঘাড় ঘুরিয়ে তিনি দেখতে পেলেন যে, ঘাটে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে পুকুরের পানা সরিয়ে পিতলের কলশিতে জল ভরছে। মেয়েটির চোখদুটি আগ্রহী হলেও তার চালচলনে লজ্জা বা জড়তা ছিল না। জল ভরে নিয়ে মেয়েটি সরাসরি গল্পকথকের দিকে তাকিয়ে তাঁর ফাতনার দিকে দৃষ্টি দেয় এবং তারপর মুখ ফিরিয়ে কলশিটা কাঁখে তুলে নেয়। ফিরে যাবার সময় হঠাৎই পেছন ফিরে মেয়েটি গল্পকথককে হাত গুটিয়ে বসে থাকার কারণ জিজ্ঞাসা করে এবং তাঁকে বড়শিতে টান দিতেও বলে। মেয়েটির কণ্ঠস্বর এমন অচঞ্চল, কমনীয় এবং গম্ভীর যে গল্পকথকের মনেই হচ্ছিল না যে, সে নিজে থেকেই অপরিচিত এক পুরুষের সঙ্গে কথা বলছে। যাইহোক, একটু পরেই ছিপে টান দিতে গিয়ে কথক দেখেন যে, বড়শিতে মাছ তো নেই-ই, টোপও নেই। নিতান্ত বিব্রত হয়ে তিনি মেয়েটির দিকে তাকান, সে তখন মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ধীর পদে ফিরে যেতে থাকে। কিন্তু সে যখন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল, তখন তার করুণ-মুখে দীপ্ত হাসির একটা ইশারা গল্পকথক দেখতে পেলেন।

এরপর একসময় ছিপ-বড়শি সমেত উঠে পড়তে বাধ্য হলেন গল্পকথক। ঘরে ফিরে গিয়ে দেখেন যে, তাঁর মাছ-ধরার পারদর্শিতার কাহিনি এরমধ্যেই কেমন করে তাঁর বন্ধুদের কানে পৌঁছে গেছে। তাঁরা তা নিয়ে তাঁর সঙ্গে উপহাস করলে গল্পকথক ব্যথিত হয়ে তাঁদের কাছে জানতে চাইলেন যে, কোথা থেকে তাঁরা সেসব জেনেছে। তাঁর মদ্যপান-বিলাসী বন্ধুটি তাঁকে জানালেন যে, আর কেউ নয়, যামিনীই তার নিজের চোখে সব কিছু দেখেছে। তখন আগ্রহী হয়ে গল্পকথক তাঁর বন্ধুর কাছে যামিনীর পরিচয় জানতে চান। তিনি জানতে পারেন যে, পুকুরঘাটে যে করুণনয়নাকে তিনি দেখেছেন, তারই নাম যামিনী, যে তাঁর পানরসিক বন্ধু মণিরই জ্ঞাতিবোন। বন্ধুটি তাঁকে একথাও জানালেন যে, তাঁদের তিনজনের সেদিনের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা যামিনীরা তাদের বাড়িতেই করেছে। আগের রাতের সেই ভগ্নপ্রাসাদটিই যে আসলে যামিনীদের বাড়ি—তা জানতে পেরে গল্পকথক অবাক হন। তিনি বুঝতে পারেন যে, ওই বাড়িরই একটি ঘরে তাঁদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। ব্যবস্থা অবশ্য সামান্যই ছিল। যামিনীই তাঁদের পরিবেশন করছিল। অপ্রয়োজনীয় লজ্জা বা অস্বাচ্ছন্দ্য যে যামিনীর নেই, তা আগেই খেয়াল করেছিলেন গল্পকথক। তবে, কাছ থেকে তার মুখশ্রীর করুণ গাম্ভীর্য আরও বেশি করে নজরে পড়ল তাঁর। এই মনুষ্য-বর্জিত, নির্জন জনবসতির নীরব সব ব্যথা যেন তার মুখে ফুটে উঠতে থাকে। পরিবেশন করবার সময় দু-চারবারের জন্য যামিনী অস্থির ও উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ছিল। 

ওপরতলার কোনো একটি ঘর থেকে মাঝে মাঝেই ক্ষীণকণ্ঠে কাউকে ডাকতে শোনা যায়। সেই ডাক শুনে যামিনী ব্যস্ত হয়ে বারবার ঘরের বাইরে চলে যেতে থাকে। প্রতিবার ফিরে আসার পর তার মুখশ্রী আরও বেদনাময় হয়ে উঠছিল। খাওয়া শেষ হবার পর তিনবন্ধু সেই ঘরেই বিশ্রাম করছিলেন। অত্যন্ত কুণ্ঠার সঙ্গে কয়েকবার ইতস্তত করবার পর যামিনী বেপরোয়া হয়েই সে ঘরের দরজার বাইরে থেকে তার জ্ঞাতিদাদা মণি-কে ডাক দেয়। মণিবাবু দরজার কাছে গিয়ে উপস্থিত হলে সেখানেই দুই ভাইবোনের কিছু কথাবার্তা হয়। তাদের কথোপকথন খুব নীচুস্বরে যেহেতু হচ্ছিল না, তাই গল্পকথক ও তাঁর ঘুমকাতুরে বন্ধুটি তা শুনতেও পেলেন। যামিনী খুব কাতর গলায় বলছিল যে, তার মা কিছুতেই তার কথা শুনছেন না। তাঁদের তেলেনাপোতা আসার খবর পাওয়ার পর থেকেই তিনি অত্যন্ত অস্থির হয়ে উঠেছেন। একথা শুনে মণিবাবু বিরক্তির সঙ্গে জানান যে, যামিনীর মায়ের সেই পুরোনো ইচ্ছে তখনও রয়ে গেছে। প্রশ্ন করেন, নিরঞ্জন এসেছে বলে তিনি ভাবছেন কিনা। উত্তরে তাঁর কথায় সম্মতি জানিয়ে যামিনী বলে যে, বৃদ্ধা অনবরত যামিনীকে বলে চলেছেন যে, নিরঞ্জন নিশ্চয়ই এসেছে। যেহেতু সে লজ্জিত, তাই বৃদ্ধার সামনে এসে দাঁড়াতে পারছে না। 

যামিনী সে কথা তার মায়ের কাছে গোপন করলেও তিনি নিরঞ্জনের আসা সম্বন্ধে একেবারে নিশ্চিত। তাই তিনি যামিনীকে বারবার করে নিরঞ্জনকে ডেকে দেবার আদেশ করছেন। সে আরও জানাল যে, অন্ধ হয়ে যাবার পর থেকে তাঁর মায়ের ধৈর্যহীনতা এতখানিই বেড়ে গেছে যে, কোনো কথা বোঝালেও তিনি বুঝতে চান না। প্রায়শই রেগে গিয়ে মাথা ঠুকে এমন ব্যাপার করেন যে, তখন ওঁর প্রাণ বাঁচানোই মুশকিলের হয়ে পড়ে। জাতিবোনের কথাগুলো শুনে গল্পকথকের বন্ধু মণিবাবু তার অসুবিধার ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। তিনি যামিনীকে জানালেন যে, বৃদ্ধা যদি চোখে দেখতে পেতেন, তা হলে তিনি হয়তো তার বন্ধুদের দেখিয়ে দিয়ে তাকে নিশ্চিত করাতে পারতেন যে, নিরঞ্জন সত্যিই আসেনি। ঠিক এই সময়েই ওপর তলা থেকে শক্তিহীন অথচ ধারালো গলার ডাক আবার শোনা গেল। তা শুনে যামিনী কাতর কণ্ঠে তার মণিদাকে ওপরে যাবার জন্য মিনতি করল। যদি মণিবাবু তার মাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে সংযত করতে পারেন। মণিবাবু যামিনীকে ওপরে যেতে বলে জানালেন যে, তিনিও যাবেন ওপরে। তারপর দরজা থেকে ঘরে ঢুকে তিনি নিজের মনেই বলতে থাকলেন যে, একটা বড়ো জ্বালাতনে পড়েছেন তিনি। 

বৃদ্ধার হাত-পা অসাড় হয়ে গেছে, চোখেও দেখতে পান না, তবুও তিনি প্রতিজ্ঞা করে বসে আছেন যে, কিছুতেই মৃত্যুবরণ করবেন না। গল্পকথক এবার বিষয়টা জানতে চাইলেন বন্ধুর কাছে। মণিবাবু জানালেন যে, ব্যাপারটা তেমন কিছু নয়। বৃদ্ধা তাঁর এক দূর সম্পর্কিত বোনপো নিরঞ্জনের সঙ্গে যামিনীর সম্বন্ধ তাদের ছেলেবেলাতেই ঠিক করে রেখেছিলেন। চার বছর আগে নিরঞ্জন এসে তাঁকে জানিয়ে গিয়েছিল যে, বিদেশের চাকরি থেকে ফিরে এসেই সে যামিনীকে বিয়ে করবে। সেই সময় থেকেই বৃদ্ধা এই ঘুমন্তপুরীতে সেই আশায় বসে থেকে দিন গুনছেন। গল্পকথক একথা শুনে তার বন্ধুকে নিরঞ্জনের বিদেশ থেকে ফিরে আসার খবর জিজ্ঞাসা করেন। বন্ধু জানান, নিরঞ্জন বিদেশে যেহেতু যায়ইনি, তাই তার দেশে ফিরে আসার প্রশ্নই ওঠে না। বৃদ্ধা নিতান্ত একগুঁয়ে ছিলেন বলেই তাঁকে সে ধোঁকা দিয়ে বিদায় নিয়েছিল। মণি এও জানালেন যে, ইতিমধ্যেই নিরঞ্জন বিয়ে করে ভালোভাবেই ঘর-সংসার করছে। কিন্তু এইসব অপ্রিয়-সত্য কথা তাঁকে কেউ বলতে পারছে না। বললেও তিনি বিশ্বাস করবেন না। আর যদি সত্যি-সত্যিই বিশ্বাস করেন, মানসিক আঘাতে তৎক্ষণাৎ তাঁর মৃত্যু হবে। এরপর মণি সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে শুরু করেন। এসময় হঠাৎই গল্পকথক নিজে থেকেই উঠে দাঁড়ান। 

তারপর বন্ধুকে জানান যে, তিনিও তার সঙ্গে যাবেন। একথা শুনে মণিবাবু অবাক হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে প্রশ্নমুখর দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলে তাঁর কোনো অমত আছে কি না তা গল্পকথক জানতে চাইলেন। তাঁর কোনো আপত্তি নেই—একথা জানিয়ে মণিবাবু অনেকখানি বিহ্বলভাবেই বন্ধুকে পথ দেখিয়ে ওপরে নিয়ে চললেন। অন্ধকার, অপ্রশস্ত এবং ভাঙা সিড়ি দিয়ে উঠে ওপরের যে ঘরটিতে তাঁরা পৌঁছোলেন, সে ঘরটি দেখে গল্পকথকের মনে হল যে, তা যেন মাটির তলার সুড়ঙ্গ পথের কোনো জায়গা। ঘরের একমাত্র জানলা বন্ধ থাকায় বাইরের অপেক্ষাকৃত আলোকিত পরিবেশ থেকে সেই প্রায়ান্ধকার ঘরে ঢুকে তার ভেতরকার সবকিছুই প্রথমে গল্পকথকের চোখে অস্পষ্ট ঠেকল। তারপর চোখ সয়ে গেলে বুঝতে পারলেন যে, ঘর জুড়ে থাকা একটি ভাঙা চৌকিতে ছেঁড়া-কাঁথা-জড়ানো একটি রোগা, কঙ্কালসর্বস্ব মূর্তি শুয়ে রয়েছে। আর, চৌকির একপাশে যামিনী পাথরের প্রতিমার মতো দাঁড়িয়ে আছে।

দুইবন্ধুর পায়ের শব্দে সেই শীর্ণকায়া চঞ্চল হয়ে উঠলেন এবং নিরঞ্জন এল কি না জিজ্ঞাসাও করলেন। নিরঞ্জন এবারও আগেরবারের মতো পালিয়ে যাবে কি না—তাও জিজ্ঞাসা করলেন। মণিবাবু এইসময় কিছু বলতে যাওয়ার চেষ্টা করতেই তাঁকে বাধা দিয়ে হঠাৎই গল্পকথক বলে বসলেন যে, না, তিনি আর পালাবেন না। একথা বলার পর তিনি বুঝতে পারলেন মণিবাবুর বিহ্বলতা এবং যামিনীর স্তম্ভিত বিস্ময়। গল্পকথক এ দুজনের দিকে না তাকিয়ে দৃষ্টিহীন চক্ষু-গোলক-দ্বয়ের দিকে রুদ্ধনিশ্বাসে, একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। এরপরই সেই মুমূর্ষু বৃদ্ধা নিরঞ্জনরূপী গল্পকথককে জানান যে, তিনি জানতেন যে সে না এসে পারবে না। সেকারণেই তিনি সেই ভূতের বাড়ি পাহারা দিয়ে প্রতীক্ষায় দিন গুনছিলেন। কথাগুলি বলার পর তিনি হাঁপাতে থাকলেন। হঠাৎই একবার যামিনীর দিকে তাকিয়ে গল্পকথকের মনে হল যে, বাইরের কাঠিন্যের মুখোশের আড়ালে তার হৃদয় যেন বিগলিত হয়ে যাচ্ছে। এতদিন ধরে প্রাণহীন এবং ভাগ্যহীন জীবনের বিরুদ্ধে গভীর নৈরাশ্য দিয়ে যে সুকঠিন প্রতিজ্ঞার বুনিয়াদ সে তৈরি করেছিল, সেই বুনিয়াদটার শিথিল হবার উপক্রম হয়েছে যেন বৃদ্ধা আবার নিরঞ্জনরূপী গল্পকথককে উদ্দেশ করে বললেন যে, যামিনীকে নিয়ে তিনি সুখীই হবেন। যামিনী তাঁর মেয়ে বলে তিনি বলছেন না, আসলে তার মতো মেয়ে হয় না। দুঃখ-কষ্টে ও যন্ত্রণায় বৃদ্ধা হয়ে তাঁর মাথার ঠিক নেই, দিনরাত অসন্তোষ প্রকাশ করে মেয়েকে তিনি অনেক কষ্ট দেন। তবু কখনও যামিনী মুখেরা কাড়ে না। তেলেনাপোতার মতো শ্মশানপুরীতে যামিনী একাই একসঙ্গে নারী ও পুরুষ হয়ে সংসারের সব ঝক্কি ঝামেলা সামলায়।

একথাগুলো শোনার পর অত্যন্ত ইচ্ছা থাকলেও গল্পকথক একবারও যামিনীর দিকে চাইতে পারলেন না, পারলেন না তার মায়ের দিকেও চাইতে। কারণ চোখের জল তিনি তখন অনেক কষ্টে সামলাচ্ছেন । যামিনীকে তিনি গ্রহণ করবেন কি না—একথা এরপর বৃদ্ধা জিজ্ঞাসা করলেন নিরঞ্জনরূপী কথককে। তিনি তাঁকে আরও জানালেন যে, তাঁর শেষ প্রতিশ্রুতি না পেলে তিনি মরেও শান্তি পাবেন না। ধরে-যাওয়া গলায় এরপর গল্পকথক তাঁকে মাসিমা বলে সম্বোধন করে জানালেন যে, যামিনীকে বিয়ে করার ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত কথা-দিচ্ছেন। তাঁর কথার কখনও অন্যথা হবে না। বিকেলবেলায় গোরুর গাড়ি মণিবাবুদের পোড়োবাড়ির দরজায় এসে দাঁড়াল। তিনবন্ধু একে একে তার ছই-এর মধ্যে উঠে পড়লেন। গাড়ি ছাড়বার সময় গাড়ির কাছে গিয়ে যামিনী গল্পকথকের দিকে করুণ-আঁখি-মেলে বলে যে, তাঁর ছিপটিপ সব কিছু যে পড়ে রইল। শুনে গল্পকথক হেসে বললেন যে, সেসব থাকুক। একবার পারেননি বলে, তেলেনাপোতার মাছ যে তাঁকে বারবার ধোঁকা দিতে পারবে না, তাও তিনি জানালেন। সেকথা শুনে যামিনী কিন্তু মুখ ফিরিয়ে নিল না। তার মুখের দিকে তাকিয়ে কথকের মনে হল, তার দুচোখের মধ্য থেকে মধুময় একটি কৃতজ্ঞতার হাসি শরতের সাদা মেঘের মতো কথকের মনকে জুড়িয়ে দিয়ে ভেসে যাচ্ছে।

গোরুর গাড়ি চলতে লাগল। দীর্ঘ এক-দেড়শো বছর আগে তেলেনাপোতায় ম্যালেরিয়া মহামারির আকার ধারণ করেছিল এবং তার ধাক্কা এই জায়গাটাকে গতিশীল ও জীবন্ত জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপে পরিণত করেছিল—এসব তথ্য আলোচিত হচ্ছিল গল্পকথকের দুজন বন্ধুর মধ্যে। কিন্তু সেসব কথা ভালোভাবে কানে যাচ্ছিল না তাঁর। তিনি কেবল তাঁর হৃৎস্পন্দনের মধ্যে এই কথাটিই বারবার উচ্চারিত হতে শুনলেন — “ফিরে আসব, ফিরে আসব”। অবশেষে কলকাতার আলোকোজ্জ্বল এবং জনবহুল রাজপথে যখন ফিরে এলেন তাঁরা, তখনও কিন্তু গল্পকথকের হৃদয়ে তেলেনাপোতার স্মৃতি ঘনিষ্ঠ নক্ষত্রের মতো ভাস্বর হয়ে অবস্থান করছে। এরপর নানাপ্রকার বাধা-বিপত্তিতে কয়েকটা দিন কাটিয়ে দিলেন গল্পকথক। তেলেনাপোতার স্মৃতি সেই দৈনন্দিনতায় কুয়াশাচ্ছন্ন হচ্ছে কি না—তা তিনি বুঝতে পারছিলেন না। অবশেষে একদিন পারিপার্শ্বিক এবং মানসিক সমস্ত বাধাবিঘ্ন দূর করে তেলেনাপোতায় যাবার জন্য তিনি তৈরি হলেন। কিন্তু যাবার দিনই আকস্মিক মাথার যন্ত্রণায় এবং কাঁপানো শীতে তিনি এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়লেন যে, লেপ-তোশক মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়তে বাধ্য হলেন। থার্মোমিটার দিয়ে দেখা গেল যে, একশো পাঁচ ডিগ্রি জ্বর। ম্যালেরিয়া' রোগটা তিনি কোথা থেকে বাধিয়ে আনলেন—ডাক্তারবাবুর এই প্রশ্ন শুনতে শুনতে জ্বরের ঘোরে বেহুঁশ হয়ে পড়লেন গল্পকথক।

বহুদিন পর অসুখ থেকে সেরে উঠে অত্যন্ত দুর্বল দেহ নিয়ে কাঁপা পায়ে বাড়ির বাইরের আলো-বাতাসে যখন গল্পকথক এসে বসলেন, তখন তিনি বুঝতে পারলেন যে, ইতিমধ্যেই তাঁর দেহ-মনে নিজের অজান্তেই অনেক ধোয়া-মোছা হয়ে গেছে। কলকাতা ফেরার দিনটিতে যে তেলেনাপোতা তাঁর কাছে ছিল ঘনিষ্ঠ এক ভাস্বর নক্ষত্র, তা বর্তমানে পরিণত হয়েছে অস্তমিত এক তারায়। সে জায়গার স্মৃতি যেন অস্পষ্ট এক স্বপ্নে পরিণত হয়েছে। তাঁর এমনও মনে হল যে, তেলেনাপোতা বলে সত্যি-সত্যিই কোথাও কিছু নেই। কঠোর ও গম্ভীর মুখ এবং সুদূর ও করুণ দৃষ্টির অধিকারী যে যামিনী ছিল সেই ধ্বংসপুরীর ছায়ার মতো, তাকেও তাঁর মনে হল কল্পনা বলে। তাঁর কোনো এক দুর্বল মুহূর্তের অসম্ভব এক কুয়াশাচ্ছন্ন কল্পনা যেন। তাই, একটিবার কিছুক্ষণের জন্য আবিষ্কৃত হয়েই তেলেনাপোতা আবার রাত্রির অতল অন্ধকারে নিমজ্জিত হল।

❐ উৎস : ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার' গল্পটি প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘কুড়িয়ে ছড়িয়ে’ (১৯৪৬) নামক গল্পগ্রন্থ থেকে সংকলিত। এছাড়াও ‘প্রেমেন্দ্র মিত্রের শ্রেষ্ঠ গল্প' (১৯৫২), 'জলপায়রা' (১৯৫৮) এবং ‘নির্বাচিতা' (১৯৭৬)–প্রেমেন্দ্র মিত্রের এই তিনটি গল্প-সংকল গ্রন্থেও গল্পটি স্থান পেয়েছে।

একাদশ শ্রেণি বাংলা দ্বিতীয় সেমিস্টার,একাদশশ্রেণি বাংলা সাজেশন,একাদশ শ্রেণি দ্বিতীয় সেমিস্টার বাংলা সাজেশন 2025,একাদশ শ্রেণি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি দ্বিতীয় সেমিস্টার,একাদশ শ্রেণি বাংলা,একাদশ শ্রেণি দ্বিতীয় সেমিস্টার বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি সাজেশন,একাদশ শ্রেণি বাংলা সেকেন্ড সেমিস্টার 2026,একাদশ শ্রেণির দ্বিতীয় সেমিস্টার বাংলা সাজেশন,একাদশ শ্রেণি দ্বিতীয় সেমিস্টার সাজেশন বাংলা

Class - XI Bengali (2nd Semester)
গল্প
ছুটি Click Here
তেলেনাপোতা আবিষ্কার Click Here
কবিতা
ভাব সম্মিলন Click Here
লালন শাহ্ ফকিরের গান Click Here
নুন Click Here
নাটক
আগুন Click Here
পূর্ণাঙ্গ সহায়ক গ্রন্থ : পঞ্চতন্ত্র
বই কেনা Click Here
আজব শহর কলকেতা Click Here
পঁচিশে বৈশাখ Click Here
আড্ডা Click Here


বাংলা শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাস | তৃতীয় অধ্যায় : আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ধারা-গদ্যসাহিত্য | কাব্য কবিতার ধারা | বাংলা নাটক ও যাত্রার ধারা |  উপন্যাস ও ছোটোগল্প | চতুর্থ অধ্যায় : লৌকিক সাহিত্যের নানা দিক | প্রবন্ধরচনা |মানস-মানচিত্র অনুসরণে -বিতর্কমূলক

বাংলা শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাস
তৃতীয় অধ্যায় : আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ধারা
গদ্যসাহিত্য Click Here
কাব্য কবিতার ধারা Click Here
বাংলা নাটক ও যাত্রার ধারা Click Here
উপন্যাস ও ছোটোগল্প Click Here
চতুর্থ অধ্যায় : লৌকিক সাহিত্যের নানা দিক Click Here
প্রবন্ধরচনা
Click Here

একাদশ শ্রেণি বাংলা তেলেনাপোতা আবিষ্কার গল্পের প্রশ্ন উত্তর | একাদশ শ্রেণী বাংলা সেমিস্টার 2 প্রেমেন্দ্র মিত্রের তেলেনাপোতা আবিষ্কার


১. 'পুকুরের ঘাটের নির্জনতা আর ভঙ্গ হবে না তারপর।'-পুকুরের ঘাটের নির্জনতা ইতিপূর্বে কীভাবে ভাগ করেছিল, সে সম্পর্কে লেখো? (মার্ক - ৫)
 প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্রের তেলেনাপোতা আবিষ্কার' নামক ছোটোগল্প থেকে প্রশ্নোদৃত উক্তিটি গ্রহণ করা হয়েছে। দুই বন্ধুকে সঙ্গে করে কলকাতাবাসী গল্পকথক তাঁর বন্ধু মণির প্ররোচনায় তাঁদের পিতৃপুরুষের বাসভূমি তেলেনাপোতায় বেড়াতে এসেছিলেন মাছ ধরার উদ্দেশ্যে। সে কারণেই তেলেনাপোতা পৌঁছানোর পরের দিন সকালেই তিনি বড়শি এবং মাছ ধরার অন্যান্য উপকরণ নিয়ে চলে যান পাশের পানাপুকুরে। সেখানকার শ্যাওলায় ঢাকা, ভাঙা ঘাটে বসে কচুরিপানা-ভরা জলে ছিপ ফেলে তিনি অপেক্ষা করছিলেন। বেলা বাড়লে, সেই জনহীন পুকুর ঘাটে কথক দেখেন যে, পুকুরটির অন্য পারে, নুয়ে-পড়া একটি বাঁশের ডগায় বসে থাকা একটি মাছরাঙা পাখি তার রঙিন দেহ নিয়ে মাঝেমাঝেই পুকুরের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে এবং ঠোঁটে মাছ নিয়ে শিকারের সার্থকতার আনন্দে, গল্পকথককে যেন বিদ্রুপ করতে করতে, আবার বাঁশের মাথায় ফিরে যাচ্ছে। একটা মোটা লম্বা সাপ তাঁকে সন্ত্রস্ত করে দিয়ে ভাঙা ঘাটটির কোনো ফাটল থেকে বেরিয়ে ধীরে সুস্থে সাঁতরে পুকুরের ওপারে গিয়ে ওঠে। দুটো ফড়িং যেন প্রতিযোগিতার মতো করে তাদের পাতলা কাচের মতো পাখা নেড়ে গল্পকথকের বড়শির ফাতনার ওপর বসার চেষ্টা করতে থাকে। সেই সঙ্গে ঘুঘু পাখি মাঝে মাঝেই তার উদাস করে, দেওয়া সুরে ডাক দিয়ে গল্পকথককে আনমনা করে দিতে থাকে।

এরপরই পুকুরঘাটের নির্জনতা ভঙ্গ হয়েছিল। আনমনা কথক হঠাৎই জলের শব্দে চমকে উঠে দেখেন যে, স্থির জল কেঁপে উঠছে এবং তাঁর বড়শির ফাতনা তাতে ধীরে ধীরে দুলছে। ঘাড় ঘুরিয়ে এরপর তিনি দেখতে পান যে, ঘাটে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে পুকুরের পানা সরিয়ে পিতলের একটি চকচকে কলশিতে জল ভরছে। মেয়েটির চোখ দুটি কৌতূহলী হলেও তার চালচলনে লজ্জা বা আড়ষ্টতার কোনো চিহ্ন ছিল না। কলশিতে জল ভরে নিয়ে মেয়েটি গল্পকথকের দিকে সরাসরি তাকিয়ে ফাতনার দিকে নজর দেয় এবং তারপর মুখ ফিরিয়ে কলশিটা কাঁখে তুলে নেয়। কলশি কাঁখে নিয়ে ফিরে যাবার সময় হঠাৎই পেছন ফিরে তাকিয়ে মেয়েটি গল্পকথককে হাত গুটিয়ে বসে থাকার কারণ জিজ্ঞাসা করে এবং তারপর কথককে বড়শিতে টান দিতেও বলে। মেয়েটির কণ্ঠস্বর এমন অচঞ্চল, কমনীয় এবং গম্ভীর ছিল যে, একজন সম্পূর্ণ অপরিচিতের সঙ্গে সে যে-কথা বলছে, তা বোঝা যাচ্ছিল না। যাই হোক, মেয়েটির উপস্থিতি এবং তার সাবলীলতায় এতটাই হতবাক হয়ে যান কথক যে, তৎক্ষণাৎ বড়শিতে টান দিতে তিনি ভুলে যান। তাই, ফাতনাটা ডুবে গিয়ে আবার যখন ভেসে ওঠে—তখনই তিনি ছিপে টান দিয়ে দেখেন যে, বড়শিতে মাছ তো নেই-ই, এমনকি টোপও নেই। অপ্রতিভ হয়ে আবার মেয়েটির দিকে তাকান কথক। সে তখন মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু মুখ-ফেরানোর মুহূর্তে সেই শান্ত, করুণ মুখে খেলে যায় দীপ্ত হাসির আভাস। এভাবেই পুকুরের ঘাটের নির্জনতা ভঙ্গ হয়েছিল। 

২. 'এই জনহীন ঘুমের দেশে সত্যি ওরকম মেয়ে কোথাও আছে আপনি বিশ্বাস করতে পারবেন না।'— প্রসঙ্গ উল্লেখ করে উদ্ধৃতিটির অর্থ বিশ্লেষণ করো। (মার্ক - ৫)
❐ প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'তেলেনাপোতা আবিষ্কার' ছোটোগল্প থেকে সংকলিত উদ্ধৃতিটিতে যে মেয়েটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সে যামিনী। প্রাত্যহিক কাজ-কর্ম এবং শহরে ভিড় ভাট্টায় হাঁপিয়ে ওঠা গল্পকথক দুদিনের ছুটি পেয়ে দুই বন্ধু-সহ মাছ ধরার উদ্দেশ্যে বেড়াতে এসেছিলেন তার এক বন্ধু মণির পূর্বপুরুষদের বাসভূমি তেলেনাপোতায়। যে গ্রাম একশো-দেড়শো বছর পূর্বেই ম্যালেরিয়ার মড়কে প্রায় উজাড় হয়ে গিয়েছিল। যামিনীর মা তেলেনাপোতা সম্বন্ধে যথার্থই বলেছিলেন যে, ‘এই শ্মশানের দেশ—দশটা বাড়ি খুঁজলে একটা পুরুষ মেলে না। যাই হোক, এই জনহীন, ঘুমের দেশেই গল্পকথক দেখতে পেয়েছিলেন ‘ওরকম মেয়ে’ যামিনীকে। 

নিস্তব্ধ পুকুরে ছিপ ফেলে বসে থাকতে থাকতে একসময় ঘুঘুর উদাস করা ডাকে আনমনা হয়ে পড়েছিলেন গল্পকথক। ঠিক এমন সময়েই হঠাৎ জলের শব্দ শুনে চমক ভেঙে তিনি দেখেন যে, স্থির জলে ঢেউ উঠছে এবং তাঁর বড়শির ফাতনা সে কারণে ধীরে ধীরে দুলছে। ঘাড় ঘুরিয়ে তখনই তিনি দেখতে পেলেন যে, ঘাটে দাঁড়িয়ে পুকুরের পানা সরিয়ে পিতলের একটি চকচকে কলশিতে জল ভরছে একটি মেয়ে। লেখক পরে জানতে পেরেছিলেন যে, সেই মেয়েটি ছিল তাঁর বন্ধু মণির জ্ঞাতিবোন যামিনী। যাই হোক, মেয়েটির চোখ দুটিতে কৌতূহলী দৃষ্টি থাকলেও তার চালচলনে সলজ্জ আড়ষ্টতার বিন্দুমাত্র চিহ্ন ছিল না। জল ভরে নিয়ে কথকের দিকে সরাসরি তাকিয়ে মেয়েটি ফাতনার দিকে তাকায় এবং তারপর মুখ ফিরিয়ে কলশিটা কাঁধে তুলে নেয়। মেয়েটির মুখশ্রীর শান্ত, করুণ, গম্ভীর ভাব দেখে তাঁর মনে হল যে, দীর্ঘকালব্যাপী এক নিষ্ঠুর জীবন-পথ বুঝি সে পার হয়ে এসেছে। তার দীর্ঘ, শীর্ণ এবং অপরিপুষ্ট শরীর দেখে কথকের আরও মনে হয় যে, বয়ঃসন্ধি পার হয়ে তারুণ্যে পৌঁছানো মেয়েটির যেন স্থগিত হয়ে আছে। যাই হোক, কুলশি কাঁধে নিয়ে ফিরে যাবার সময় হঠাৎই পেছন ফিরে তাকিয়ে মেয়েটি গল্পকথককে হাত গুটিয়ে বসে থাকার কারণ জিজ্ঞাসা করে এবং তাঁকে বড়শিতে টান দিতেও বলে। মেয়েটির গলার স্বর এমন অচঞ্চল, কমনীয় ও গম্ভীর ছিল যে, কথকের মনেই হচ্ছিল না সেই গ্রাম্য তরুণীটি অপরিচিত এক পুরুষের সঙ্গে কথা বলছে।

সম্পূর্ণ অপরিচিত এক পুরুষের সঙ্গে মেয়েটির ব্যবহারের সাবলীলতায় বিস্মিত ও অভিভূত হয়ে গিয়ে শহুরে কথক বড়শিতে টান দিতে দেরি করেন। যখন তিনি ছিপে টান দেন, তখন দেখেন যে তাতে মাছ তো নেই-ই, এমনকি টোপও নেই। ফলে অত্যন্ত বিব্রত হয়ে তিনি মেয়েটির দিকে তাকান। সে তখনই মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে ফিরতে থাকে। কিন্তু তার মুখ-ফেরানোর মুহূর্তে সেই করুণ মুখে খেলা করা উজ্জ্বল হাসির এক ইশারা কথকের নজরে পড়ে। তাই মেয়েটি চলে যাবার পর অনেকক্ষণ ধরে কথক চিন্তা করতে থাকেন তার কথা। তেলেনাপোতার মতো এই নিদ্রাপুরীতে তেলেনাপোতার উপযোগী চেহারা ও মুখ-ভঙ্গির অধিকারী কোনো মেয়ে যে আছে এবং তার আচরণ এমন সহজ-সরল-স্বাভাবিক ও অলজ্জ যে কলকাতাবাসী যুবককে তা বিস্মিত করে দেয়—একথা ভেবেই গল্পকথক প্রশ্নে সংকলিত উদ্ধৃতিটি করেছিলেন।

৩. 'তেলেনাপোতা আবিষ্কার' ছোটোগল্প অবলম্বনে গল্পকথকের সঙ্গে যামিনীর শেষ সাক্ষাৎকারটি বর্ণনা করো। এর ঠিক আগে কোথায় তাদের মধ্যে সাক্ষাৎ ঘটেছিল ? সেই সাক্ষাৎকারটি বর্ণনা করো। (মার্ক ২+৩=৫)
❐ প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্পের গল্পকথকের সঙ্গে যামিনীর পঞ্চম তথা শেষ বার সাক্ষাৎকার ঘটে তেলেনাপোতা থেকে কথকদের ফিরে যাওয়ার মুহূর্তটিতে। মুণিবাবুদের পোড়োবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গোরুর গাড়িতে গল্পকথকরা উঠে পড়ার পর যখন গাড়িটি ছাড়বার উপক্রম করলি, তখন যামিনী গল্পকথকের দিকে করুণ চোখ মেলে বলে যে, তাঁর ছিপটিপ সবকিছুই যে পড়ে রইল। শুনে গল্পকথক হেসে বলেন যে, সেসব সেখানেই থাকুক। তেলেনাপোতায় এসে প্রথমবার মাছ শিকারে ব্যর্থ হয়েছেন বলে, বারবার তেলেনাপোতার মাছ কিন্তু মোটেও তাঁকে ফাঁকি দিতে পারবে না। কথাগুলি শুনে যামিনী কিন্তু মুখ ফিরিয়ে নেয় না। যামিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে কথকের মনে হল, তার দু-চোখের মধ্য থেকে মধুময় কৃতজ্ঞতার হাসি শরতের সাদা মেঘের মতো কথকের মনকে জুড়িয়ে দিয়ে যেন ভেসে যাচ্ছে।

এর আগে, অর্থাৎ চতুর্থবার যামিনী এবং গল্পকথকের সাক্ষাৎ ঘটে যামিনীর মায়ের দোতলার ঘরে। মণিবাবুর সঙ্গে যামিনীর মার ঘরে ঢুকে গল্পকথক দেখতে পান যে, ঘর জুড়ে থাকা একটি ভাঙা তক্তাপোশে ছেঁড়া-কাঁথা-জড়ানো কঙ্কালসার চেহারার যামিনীর মা শুয়ে রয়েছেন। চৌকির একপাশে পাথরের প্রতিমার মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে যামিনী) দুই বন্ধুর পদশব্দ শুনে বৃদ্ধা মনে করলেন যে, যামিনী যার বাগদত্তা, সেই নিরঞ্জন এসেছে। এরপর উৎফুল্ল হয়ে নিরঞ্জনকে উদ্দেশ্য করে বেশ কিছু আবেগপ্রবণ কথা বৃদ্ধা বলে চললেন এবং নিরঞ্জন আগের বারের মতো পালিয়ে যাবে কি না তাও জিজ্ঞাসা করলেন। বুন্ধু মণি ও যামিনীকে স্তম্ভিত করে দিয়ে গল্পকথক নিরঞ্জন হয়ে যামিনীর অসহায়, অন্ধ, বৃদ্ধা মাকে যামিনীকে বিবাহ করার ব্যাপারে আশ্বাস দিয়ে আসেন।

এরপর নিশ্চিন্ত যামিনীর মা নিরঞ্জন ভেবে গল্পকথককে আরও অনেক কথা বলে হাঁপাতে থাকলে কথক যামিনীর দিকে তাকান। তাঁর মনে হয় যে, বাইরের কঠিন মুখোশের অন্তরালে তার মধ্যেও কোথাও যেন কি ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে—ভাগ্য ও জীবনের বিরুদ্ধে, গভীর হতাশার উপাদানে তৈরি এক সুদৃঢ় শপথের ভিত্তি আলগা হ'য়ে যেতে আর বুঝি দেরি নেই”। এরপর বৃদ্ধা আরও জানালেন যে, যামিনীকে নিয়ে তিনি সুখী হবেন এবং যামিনীর অনেক প্রশংসা করেন। বৃদ্ধার সেই আকুতিভরা কথাগুলি শুনে কথক কোনোদিকে তাকাতে পারলেন না, পাছে চোখের জল তিনি গোপন করতে না পারেন। তাই বৃদ্ধা এরপর যখন আবার তাঁকে প্রশ্ন করেন, ‘যামিনীকে তুই নিবি ত বাবা', তখন গল্পকথক স্পষ্টভাবেই তাঁকে কথা দেন যে, 'আমি তোমায় কথা দিচ্ছি মাসিমা। আমার কথার নড়চড় হবে না।

৪. 'তেলেনাপোতা আবিষ্কার' গল্পের গল্পকথক তেলেনাপোতার পানাপুকুরে ছিপ ফেলে যখন বসে ছিলেন, তখন বিভিন্ন প্রাণী কীভাবে তাঁকে বিরক্ত করেছিল সেই প্রসঙ্গ বিবৃত করে বলো এরপরের কোন ঘটনা গল্পকথকের কাছে “অবাস্তব বলে মনে হবে" ? (মার্ক - ৫)
 পুকুর ঘাটের পরিবেশ : প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার' গল্পের গল্পকথক তেলেনাপোতার পানাপুকুরে বড়শি ফেলে ঘাটে একাকী বসে ছিলেন। বেলা বাড়লে তিনি দেখেন যে, পুকুরটির অন্য পারে নুয়ে পড়া একটি বাঁশের ডগায় বসে থাকা একটি মাছরাঙা পাখি মাঝেমাঝেই পুকুরের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে এবং ঠোঁটে মাছ নিয়ে সার্থকতার আনন্দে আবার বাঁশের মাথায় ফিরে যাচ্ছে। মাছরাঙাটির আনন্দ ও উচ্ছ্বাস দেখে গল্পকথকের মনে হয় যে, মাছরাঙাটি যেন তাকে পরিহাস ও বিদ্রুপ করার জন্যই এমনটা করছে। একটা মোটা, লম্বা সাপ গল্পকথককে বিস্মিত করে দিয়ে ভাঙা ঘাটটির কোনো ফাটল থেকে বেরিয়ে ধীর-স্থির ভাবে সাঁতরে পুকুরের ওপারে গিয়ে ওঠে। দুটি ফড়িং যেন প্রতিযোগিতা করে তাদের পাতলা কাচের মতো পাখা নেড়ে গল্পকথকের বড়শির ফাতনার ওপর বসার চেষ্টা করতে থাকে। ঘুঘু পাখি মাঝে মাঝেই তার উদাস করে দেওয়া সুরে ডাক দিয়ে গল্পকথককে আনমুনা করে দিতে থাকে।

 মাছ শিকার : ঘুঘু পাখির ডাকে উদাস হয়ে যাওয়া গল্পকথক এরপর হঠাৎই জলের শব্দে চমকে গিয়ে দেখেন যে, পুকুরের স্থির,সবুজ জলে ঢেউ উঠেছে এবং তাঁর বড়শির ফাতনা ধীরে ধীরে দুলছে। ঘাড় ঘুরিয়ে অতঃপর তিনি লক্ষ করেন যে, ঘাটে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে পুকুরের পানা সরিয়ে পিতলের একটি চকচকে কলশিতে জল ভরছে। মেয়েটির চোখদুটি কৌতূহলী হলেও, তার চালচলনে লজ্জা বা আড়ষ্টতার লেশমাত্র ছিল না। জল ভরে নিয়ে মেয়েটি সরাসরি গল্পকথকের দিকে তাকিয়ে তাঁর ফাতনার দিকে দৃষ্টি দেয় এবং তারপর মুখ ফিরিয়ে কলশিটা কাঁধে তুলে নেয়। মেয়েটির মুখশ্রীর শান্ত, করুণ ও গম্ভীর ভাব দেখে কথকের মনে হল যে, মেয়েটি দীর্ঘকাল ধরে নিষ্ঠুর জীবনপথ পার হয়ে এসেছে। মেয়েটির দীর্ঘ, শীর্ণ এবং অপরিপুষ্ট চেহারা দেখে গল্পকথকের আরও মনে হয় যে, বয়ঃসন্ধি পার হয়ে তারুণ্যে পৌঁছোনো যেন তার স্থগিত হয়ে গেছে। ফিরে যাওয়ার সময় হঠাৎ-ই পেছন ফিরে তাকিয়ে মেয়েটি গল্পকথককে হাত গুটিয়ে বসে থাকার কারণ জিজ্ঞাসা করে এবং তাকে বড়শিতে টান দিতে বলে। অভিভূত গল্পকথক ফাতনাটি ভেসে ওঠার পরপরই বড়শিতে টান দিয়ে দেখেন যে, তাতে মাছ তো নেই-ই, এমনকি টোপও নেই। বিব্রত হয়ে মেয়েটির দিকে চেয়ে দেখেন যে, সে দীপ্ত হাসি-মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ধীর পদে ফিরে চলেছে। এই ঘটনাই কথকের কাছে অবাস্তব মনে হয়েছিল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)